কুমিল্লায় জালিয়াতি করে এক রোহিঙ্গা নাগরিকের জন্মনিবন্ধন করে দেওয়া নিয়ে পাশাপাশি দুই ইউনিয়নের মাঝে তুলকালাম চলছে। জালিয়াতি করে রোহিঙ্গা নাগরিককে জন্মনিবন্ধন করে দেওয়ার দায়ে সেই রোহিঙ্গা নাগরিক, জালিয়াতি চক্রের কয়েকজন সদস্য এবং ইসমাইল হোসেন নামের এক ইউপি সচিব কারাগারে আছেন। জেলা প্রশাসন থেকে বরখাস্ত হয়েছেন আনিছুর রহমান নামের পাশের ইউনিয়নের আরেক সচিব। 

জালিয়াতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে থাকা ইউপি সচিব পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে চক্রের বাকী সদস্যদের নাম বলে দেওয়ার ভয়ে সেই চক্রটি ইউপি সচিব ইসমাইলকে কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য জোর তৎপরতা চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। 

অপরদিকে, জেলা প্রশাসন থেকে বরখাস্ত হওয়া আনিছুর রহমানকে ফাঁসানো হয়েছে দাবি করে পুনরায় তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসনে লিখিত আবেদন করেছেন তিনি। এ ঘটনা নিয়ে দুই ইউপিতে চলছে তুমুল আলোচনা। 

জালিয়াতির অভিযোগে কারাগারে থাকা ইসমাইল হোসেন জেলার মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের নিবন্ধন সহকারী (সচিব) এবং জেলা প্রশাসন থেকে বরখাস্ত হওয়া আনিছুর রহমান একই উপজেলার পাহাড়পুর ইউনিয়নের নিবন্ধন সহকারী (সচিব)। ইউনিয়ন দুটি পাশাপাশি অবস্থিত।

মামলার বরাত দিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি দুপুরে কুমিল্লা আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে মুরাদনগর উপজেলার সদর ইউনিয়নের ঘোড়াশাল গ্রামের ভুয়া পরিচয়ে জন্ম নিবন্ধন বানিয়ে পাসপোর্ট করতে এসে ইয়াছির (১৯) নামের এক রোহিঙ্গা যুবক পাসপোর্ট কর্মকর্তাদের হাতে আটক হন। তিনি পাসপোর্ট অফিস-সংলগ্ন মদিনা ট্রাভেলসের হাসান মাহমুদ ও মোশাররফ নামে দুই দালালের কাছে পাসপোর্ট করার চুক্তি করেন। পরে হাসান মাহমুদ ও মোশাররফ কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার পশ্চিম ঘোড়াশাল গ্রামের ভুয়া ঠিকানায় রোহিঙ্গা যুবক ইয়াছিরের সকল কাগজপত্র তৈরি করে দেন। ওই ঘটনায় কোতোয়ালি মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করেন পাসপোর্ট অফিসের অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার অপারেটর মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন। 

পরে পাসপোর্ট অফিস এলাকা এবং মুরাদনগর থেকে জালিয়াতিতে জড়িত ফয়সাল, মোশারফ, নাসির উল্লাহ ও শরীফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। আসামিদের স্বীকারোক্তির পর গত ২০ জুন রাতে গ্রেপ্তার হন মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের নিবন্ধন সহকারী ইসমাইল হোসেন। 

অভিযোগ রয়েছে, রোহিঙ্গা যুবক ইয়াছিরের ভুয়া জন্মনিবন্ধন মুরানগরের সদর ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকার রেজিস্ট্রার কার্যালয় থেকে নিবন্ধনের কারিগরি প্রতিবেদন মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের না এনে পাশের পাহাড়পুর ইউনিয়নের প্রতিবেদন আনা হয়। এতে দায় চাপিয়ে দেয় পাহাড়পুর ইউনিয়নের ওপর। এ ঘটনায় নিবন্ধন সহকারী (সচিব) আনিছুর রহমানকে গত ২১ আগস্ট সাময়িক বরখাস্ত করে জেলা প্রশাসন। 

এ বিষয়ে গত ১২ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলা প্রশাসক বরাবরে বিষয়টির পুনরায় সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে লিখিত অভিযোগ করেন বরখাস্ত হওয়া পাহাড়পুর ইউনিয়নের নিবন্ধন সহকারী (সচিব) আনিছুর রাহমান। 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, আসল জন্মনিবন্ধনটি ছিল পাহাড়পুর ইউনিয়নের। যা জালিয়াতি করেছে সদর ইউনিয়ন পরিষদ। গত ৬ ফেব্রুয়ারি ইস্যুকৃত জন্মনিবন্ধনের প্রিন্ট কপিতে স্বাক্ষর করেছেন সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী তুফরিজ এটন ও নিবন্ধন সহকারী (সচিব) ইসমাইল হোসেন। এর আগে গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা যুবক ইয়াছিরও আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ভুয়া জন্মনিবন্ধনটি ইসমাইলের নিকট থেকে নিয়েছেন বলে জানিয়েছিলেন। 

অপরদিকে স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, কারাগারে থাকা সচিব ইসমাইল আরও বেশ কিছু ভুয়া জন্মনিবন্ধন ও ভুয়া এনআইডির মাধ্যমে চক্রের সহায়তায় রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট করিয়ে দেওয়া একাধিক চক্রের সঙ্গে জড়িত। একটি চক্র ধরা পড়লেও, অপর চক্রগুলো তাকে জেল থেকে মুক্ত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। 

সূত্রটি আরও জানিয়েছে, ইসমাইলকে মামলার দায় থেকে রক্ষা করতে এরই মধ্যে চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকার ফান্ড সংগ্রহ করেছে। রোহিঙ্গাদের ভুয়া জন্মনিবন্ধনের মাধ্যমে গ্রেপ্তার নিবন্ধন সহকারী ইসমাইল বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।  

এ বিষয়ে পাহাড়পুর ইউনিয়ন পরিষদের নিবন্ধন সহকারী (সচিব) আনিছুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জালিয়াতিতে গ্রেপ্তার রোহিঙ্গা নাগরিক এ  জালিয়াতির চক্রের সদস্যরা সবাই স্বীকার করেছেন যে সদর ইউপি সচিব ইসমাইল হোসেনের মাধ্যমে তারা ভুয়া জন্মনিবন্ধনটি করিয়েছিলেন। তারা আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিও দিয়েছেন। নিবন্ধনের কারিগরি প্রতিবেদন পাহাড়পুর ইউনিয়নের দেখিয়েছেন। এখানে আমাদের দোষটা কী? কেউ যদি জালিয়াতি করে আমাদের নাম ব্যবহার করে সেখানে আমাদের করণীয় কী? আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে পুনরায় তদন্তের জন্য লিখিত অনুরোধ জানিয়েছি।

মুরাদনগর উপজেলা সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কাজী তুফরিজ এটন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরো বিষয়টি ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। জালিয়াতি কোথা থেকে হয়েছে তা লুকানোর সুযোগ নেই। জন্মনিবন্ধনের প্রিন্ট কপিতে তার (ইউপি চেয়ারম্যান এটন) স্বাক্ষরটি স্ক্যান করা বলে তিনি দাবি করেন। 

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন দাস ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্থানীয়ভাবে তদন্ত ও গ্রেপ্তার আসামিদের জবানবন্দির পর রোহিঙ্গা যুবককে ভুয়া জন্মনিবন্ধন দেওয়ার অভিযোগে মুরাদনগর সদর ইউনিয়নের সচিব (নিবন্ধন সহকারী) ইসমাইল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। ভুয়া জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্ত শেষে শিগগিরই আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে।

কুমিল্লার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক এসএম গোলাম কিবরিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, যেহেতু মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে এবং গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে, সেহেতু আদালতে বিচারাধীন কেনো বিষয় নিয়ে কথা বলা যাবে না।

আরিফ আজগর/এএমকে