• খাল দখল-ভরাটে আছে নগর কর্তৃপক্ষ
  • জলাশয় ভরাট করে সরকারি অবকাঠামো নির্মাণ
  • পুকুর ভরাটে নেই বাধা
  • বিকল ড্রেনেজ সিস্টেম

বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে বরিশালে টানা তিন দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয় ১৪ সেপ্টেম্বর, এদিন ১৭৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। বিগত এক সপ্তাহেও শহর লাগোয়া কীর্তনখোলা নদীর পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। অথচ ৫৮ বর্গকিলোমিটারের বরিশাল সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকায় জলাবদ্ধতার তৈরি হয়েছে। শহরের মধ্যবর্তী বটতলা এলাকার চিত্রটি একটু ভিন্ন। শহরের বর্ধিত এলাকায় যে উচ্চতায় জলাবদ্ধতা হয়েছে তারও দ্বিগুণ জলাবদ্ধতা বটতলা থেকে চৌমাথা সড়কে।

এখানেই ক্ষুদ্র ব্যবসা করেন ষাটোর্ধ্ব আবুল হোসেন। তিনি বলেন, বর্ষার পুরো সময় আমরা জলাবদ্ধতায় থাকি। এখানে জলাবদ্ধতার জন্য কোনো ঝড়-বন্যার দরকার হয় না। আকাশে হালকা বৃষ্টি বা নদীতে জোয়ার আসলেই পানিতে তলিয়ে যায়।

পানি একবার উঠলে তিন-চার দিনেও তা নেমে যাওয়ার সুযোগ থাকেন না। প্রচণ্ড রোদ উঠলে কিছু পানি শুকায় আর কিছু মাটিতে শুষে নেয়। এমন কোনো ড্রেন নেই যা দিয়ে পানি বেরিয়ে যাবে।—মাহমুদ হোসেন নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন এই কথা।

শুধু যে বটতলা এলাকা এমন নয়—সদর রোড, সার্কুলার রোড, কলেজ রোড, কাউনিয়া শিল্প এলাকা, আমানতগঞ্জ, রূপাতলী হাউজিং, সোহরাফ হাউজিং, টিয়াখালী, নবগ্রাম এলাকাসহ শহরের প্রায় সবগুলো অংশেই দীর্ঘ জলাবদ্ধতার তৈরি হয়।

নথুল্লাবাদ বাস টার্মিনাল-সংলগ্ন শাহ পড়ান সড়কের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন বলেন, এই স্থানটিতে পাঁচ-ছয় বছর আগেও জলাবদ্ধতা হতো না। আমাদের কাছেই বড় বড় কয়েকটি জলাশয় ছিল। সেগুলো ভরাট করে সরকারি অফিস স্থাপনের পর থেকেই আমরা জলাবদ্ধতায় পড়েছি। তারা এগুলো দূরে কোথাও করতে পারতেন। এমনভাবে করেছেন যেন ইচ্ছা করে তারা আমাদের ডুবিয়েছেন।

কী কারণে জলাবদ্ধতা?

দিনে দিনে প্রকট জলাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার তৈরি হলেও নগর কর্তৃপক্ষ দায়সারা দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো সমন্বিতভাবে কাজ না করার কারণেই কৃত্রিম জলাবদ্ধতার সংকট তৈরি হয়েছে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্ট্যাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক বলেন, বরিশাল কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী শহর। এই শহরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হবে, এমনটা ভাবা যায় না। অথচ বাস্তবে জলাবদ্ধতায় নাকানি-চুবানি খাচ্ছে এই শহরের মানুষ। এর কারণ ক্যাচমেন্ট এরিয়া থেকে পানি অপসারণের সুযোগ নেই। শহরের যতগুলো জলাধার বা পুকুর ছিল তা ভরাট করে দিনে দিনে স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। খাল, নালা মেরে ফেলা হয়েছে। এমনকি সচল কোনো ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। ফলে বৃষ্টিপাতে বা জোয়ারে পানি উঠলে তা নেমে যাওয়ার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, স্থাপনাগুলো যখন নির্মাণ করা হয় তখন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ না নিয়ে অনুমান নির্ভর কাজ করা হয়। এর ফল শহরবাসী ভোগ করছেন। জনবসতিপূর্ণ একটি শহরে সবকিছুই তো পরিকল্পনা মাফিক হওয়ার কথা। বাস্তবতা হলো, কোনো কিছুই পরিকল্পিত নয়। সুতরাং শহরের জলাবদ্ধতার এমন করুণ অবস্থা তৈরি হয়েছে কৃত্রিম উপায়েই।

ড. হাফিজ আশরাফুল হক মনে করেন, বিশেষজ্ঞদের দিয়ে পরিকল্পিতভাবে নগরের উন্নয়নে এখনো কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের জলানুসন্ধান বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, কয়েক দিনের নিপ টাইড মানে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমার মাঝামাঝি সময় থাকায় নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ সময়ে নদ-নদীর পানি ধারণক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন সমস্যার কারণে বৃষ্টির পানি নদীতে গিয়ে পৌঁছাতে পারছে না। যে কারণে বরিশাল নগরীর বেশির ভাগ অঞ্চলে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় জানা থাকলেও আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করছি না।

তিনি বলেন, বরিশাল নগরীতে ২৪টি সচল খালের পাশাপাশি সরকারি, ব্যক্তিমালিকানার তিন হাজারের বেশি পুকুরও ছিল। অথচ খাল ও পুকুরগুলোকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার ওপরে নগরীতে পরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকায় বৃষ্টির পানি নদীতে গিয়ে পৌঁছতে যথেষ্ট সময় নেয়। ড্যাপ ঢাকা শহরে জলাধারগুলো সংরক্ষণ ও কার্যকর করার প্রস্তাব রেখেছে। প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করে জলাধার সৃষ্টি করার প্রস্তাব দিয়েছে। অথচ বরিশালে গণহারে জলাধার বা পুকুর ভরাট করে অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে বিধায় অসহনীয় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে।

উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মাসুম বলেন, কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট এই জলাবদ্ধতায় যে শুধু ব্যক্তি জড়িত, তেমনই নয়। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সরাসরি জড়িত। নগরীর নুথুল্লাবাদ বাস টার্মিনালের বিপরীতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভবন, শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার নির্মাণ, পাসপোর্ট অফিস, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড—সবগুলো ভবন জলাশয় ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে। ত্রিশ গোডাউন এলাকায় ক্যান্সার হাসপাতালসহ নগরীর অনেক স্থানে জলাধার ভরাট করে সরকারি-বেসরকারি ভবন নির্মিত হচ্ছে। জলাধার ভরাট করে ফেললে পানি নেমে জমা হওয়ার কোনো স্থান পায় না। যে কারণে জলাবদ্ধতার তৈরি করে।

যেভাবে দুর্ভোগের সূত্রপাত

খাল ও পুকুর ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে শহরে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি তৈরির জন্য খোদ নগর কর্তৃপক্ষকেই দুষছেন বাসিন্দারা। সুপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত যেমন তৈরি করতে পারেনি তেমনি জলাশয় ভরাট, খাল দখলে বাধা দেয়নি অতীত-বর্তমানের কেউ। উলটো নগর কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে খাল-পুকুর ভরাট করার তথ্যও উঠে এসেছে। ১৯৯৮ সালে তৎকালীন বরিশাল পৌরসভার মেয়র আহসান হাবিব কামালের সময়েই বটতলা থেকে চৌমাথা পর্যন্ত খালটি দখল করে তার ওপরে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ করা হয়। ২০০০ সালে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা থেকে বরিশাল সিটি করপোরেশনে উন্নীত হয়। ২০০৩ সালে তৎকালীন মেয়র অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার মেয়র থাকাকালীন নবগ্রাম থেকে বটতলা পর্যন্ত খাল ভরাট করে মার্কেট সম্প্রসারিত করা হয়। পরবর্তী মেয়র শওকত হোসেন হিরণ বটতলা খালের ওপর সড়ক নির্মাণ করেন। একইভাবে তিনি নগরীর ভাটার খালের সার্কিট হাউজের পেছনের অংশে খালকে ড্রেনে রূপান্তরিত করে তার উপরে রাস্তা নির্মাণ করেন। তা ছাড়া খালের বিভিন্ন স্থানে নির্মাণ করা হয় বক্স কালভার্ট। নগর কর্তৃপক্ষের এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ডে অন্যান্যরাও উদ্বুদ্ধ হয়ে যে যার মতো করে জলাশয় ভরাট, খাল দখল করে পরিবেশ নষ্ট করে ফেলেন।

পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়ক লিংকন বায়েন বলেন, বরিশালে এবারই যে বৃষ্টিপাত হয়েছে তাতে এমন অসহনীয় জলাবদ্ধতা হওয়ার কথা না। অথচ যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে তাতে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার চার-পাঁচ দিন পরেও পানি নামবে না। কারণ আমাদের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খাল-পুকুর মেরে ফেলা হয়েছে। যে কয়টি খাল রয়েছে তা-ও সচল না। মানুষ ময়লা-আবর্জনা ফেলে বন্ধ করে রেখেছে। পানি নামতে পারছে না।

সিটি করপোরেশনের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ৫৮ বর্গ কিলোমিটারের নগরীতে ৬৮ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থার দরকার। বাস্তবতায় ৩০ কিলোমিটারের বেশি ড্রেনেজ নেই। এই যে ৩০ কিলোমিটার ড্রেনেজ নির্মাণ করা হয়েছে তার ৫ শতাংশও সচল নেই। ফলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়া অবশ্যম্ভাবী।

লিংকন বায়েন আরও বলেন, নগর কর্তৃপক্ষ শহরের ভারসাম্য, পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার কথা। আমরা দেখছি, তাদের উদ্যোগেই বিগত দিনে খাল-পুকুর ভরাট করা হয়েছে।

কৃত্রিম জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে খালগুলো দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করা, পুকুর ভরাট বন্ধ করা এবং বেশি বেশি পুকুর খনন করা, যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা না ফেলা, সুপরিকল্পিত ড্রেনেজ সিস্টেম চালু করার কথা বলেন এই পরিবেশবিদ।

যা বলছে কর্তৃপক্ষ

জলাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে বরিশাল সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইসরাইল হোসেন জানিয়েছেন, সমস্যা থেকে উত্তরণে ইতোমধ্যে নগরীর মধ্যের গুরুত্বপূর্ণ সাতটি খাল খননের কাজ শুরু করা হয়েছে। পাশাপাশি ড্রেনেজ ব্যবস্থা উন্নত করতে কাজ চলছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বরিশালের নির্বাহী প্রকৌশলী খালিদ বিন ওয়ালিদ বলেন, সমস্যা হচ্ছে নগরীর খাল, ডোবা, নালা ও পুকুর ভরাট করে বহুতল বাড়ি থেকে শুরু করে সড়ক, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এতে অল্প বৃষ্টি বা জোয়ারেই বসতবাড়ি, সড়ক প্লাবিত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা থেকে বাঁচতে ইতোমধ্যে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে সাতটি খাল খনন করা হয়েছে। এতে করে জলাবদ্ধতা অনেক কমে এসেছে।

তিনি বলেন, নগরীর ড্রেনেজ সিস্টেম সচল রাখা গুরুত্বপূর্ণ। ড্রেন প্রতি বছর পরিষ্কার করা উচিত। পাশাপাশি নগরী দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোর পুনঃখনন প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এএমকে