বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে দেশের বিভিন্ন দেয়ালের রূপ-যৌবন। দেশের বিভিন্ন স্থানে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নান্দনিক ও চোখ ধাঁধানো গ্রাফিতি ও ক্যালিগ্রাফি। দেশজুড়ে শিল্পকর্ম, প্রতিবাদী স্লোগান ও দেয়াল লিখনের কার্যক্রম পরিচালনা করছেন শিল্পীরা। যা দেখে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যরকম পারদ হিসেবেও আখ্যায়িত করেন অনেকেই। এসব শিল্পকর্ম দেখে অনেকে উৎসাহ পান।

তেমনই এক ক্যালিগ্রাফি নজর কেড়েছে পূর্বাঞ্চলের ১৮ জেলার মানুষদের। ছয় হাজার স্কয়ার ফুটের এই বিশাল ক্যালিগ্রাফি আঁকা হয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুর ব্রিজের পূর্বঢালের দেয়ালে। ফেসবুকে ইতোমধ্যে এটি ছড়িয়ে পড়েছে। আরবি হরফের সাধারণ গাঁথুনি দিয়ে গড়ে তোলা নান্দনিক এই শিল্পকর্ম প্রশংসায় ভাসছে নেটিজেনদের।  

ঐক্যের ওপর জোর দেওয়া আরবি হরফগুলো অনন্য সুন্দরভাবে লেখা হয়েছে ওই ক্যালিগ্রাফিতে। কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর লাল-সাদা রঙে ফুটিয়ে তোলা হয় সৃজনশীল এই শিল্পকর্ম। এটা দেখে যে কেউই মুগ্ধ হয়ে অবচেতন মনে তাকিয়ে থাকেন। ক্যালিগ্রাফিকে কেন্দ্র করে পথচারীরা দাঁড়িয়ে তুলছেন সেল্ফি। দর্শক, পথচারীদের অনেকের মন্তব্য—এত বড় গ্রাফিতি তারা এর আগে কখনো দেখেননি। 

চোখ ধাঁধানো এই ক্যালিগ্রাফি আঁকতে নেতৃত্ব দিয়েছেন মোল্লা মোহাম্মদ হানিফ নামে একজন শিল্পী। নিজেদের মনের মতো করে ফুটিয়ে তুলতে ১২ দিন সময় নিয়েছেন তিনি ও তার দল। 

শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) রাতে এক ফেসবুক পোস্টে এই ক্যালিগ্রাফির ছবি প্রকাশ করে মোল্লা মোহাম্মদ হানিফ লেখেন, একতাই শক্তি—শিরোনামে আমাদের নতুন কাজ। আমাদের টিম ১২ দিন কাজের মধ্যে দিয়ে কাজটা সম্পন্ন করতে পেরেছি, আলহামদুলিল্লাহ। 

কাজের বর্ণনা দিতে গিয়ে ফেসবুক পোস্টে তিনি আরও লেখেন, কাজের শুরুতেই ডান দিক থেকে القوة في الوحدة (একতাই শক্তি) লেখা আছে। মাঝে মুষ্টিবদ্ধ দুটি হাত। একটি হারিয়ে যাওয়া জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরেকটি দল এসে একতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে এবং চতুর্পাশে ইনকিলাব, ইত্তিহাদ, ইন্তিফাদার ম্যাসেজ এবং আমাদের শেষ বার্তা ছিল—الصين لنا والعرب لنا والهند لنا والكل لنا (একতাবদ্ধ হলে চীন, আরব, হিন্দ এবং পুরো বিশ্বটাই আমাদের হবে, ইনশাআল্লাহ)। 

রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, দাঁড়িয়ে এক নজর দেখছেন না—এমন মানুষ খুব কম। দর্শনার্থীরা বলছেন, আমাদের ছেলেরা আমাদেরকে ঐক্যের ডাক দিয়েছেন। ঐক্যবদ্ধ হওয়া শিখিয়েছেন। আমরা এই ঐক্য ধরে রাখতে পারলে আমাদের কেউ হারাতে পারবে না।

ক্যালিগ্রাফি দেখে অনেকটা আবেগ নিয়ে কবি নজরুল কলেজের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের ছাত্র ওয়াসিব আহমেদ নাহিদ বলেন, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে দৃষ্টিনন্দন এই ক্যালিগ্রাফি করেছে মাদ্রাসার ছাত্ররা। আমার কাছে মনে হয়, এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ অ্যারাবিক ক্যালিগ্রাফি। প্রায় ছয় হাজার স্কয়ার ফিট জায়গাজুড়ে এটা আঁকা হয়েছে। ফেসবুকে দেখেছি, হানিফ ভাই লিখেছেন, ‘একতাই শক্তি’ শিরোনামে তাদের এই কাজ। আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। এটাই তিনি বুজিয়েছেন। তাদের অনেকগুলো দৃষ্টিনন্দন কাজ আমি দেখেছি, তার মধ্যে এটি অন্যতম, প্রতিভা বিকাশের এই সুস্থ প্রতিযোগিতা অব্যাহত থাকুক। এগিয়ে যাক তারা, এগিয়ে যাক পুরো দেশ—এটাই আমার কাম্য।

কমফোর্ট ডেন্টালের ডেন্টিস্ট মোহাম্মদ শাহারিয়ার বলেন, ফেসবুকে এই ক্যালিগ্রাফিটা দেখেই আমার নজর কাড়ে। আমার এলাকার পাশেই এত সুন্দর আর বড় ক্যালিওগ্রাফি আঁকা হয়েছে, তাই দেখতে এসেছি। বাংলাদেশ আবার নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। আগে তো আমরা কথা বলতে পারতাম না। আমরা এখন বাক স্বাধীনতা ফিরে পেয়েছি। সবাই এখন মন খুলে কথা বলতে পারছে। এই গ্রাফিতির মাধ্যমে শিল্পীরা স্বাধীনভাবে সাধারণ মানুষের মনের ভাবগুলোই ফুটিয়ে তুলেছে। আমি এর আগে ঢাকার টিএসসিসহ বিভিন্ন জায়গায় অনেক গ্রাফিতি দেখেছি। কিন্তু এই ক্যালিগ্রাফি দেখে আমার কাছে অন্য রকম লাগছে। এটা শুধু ক্যালিগ্রাফিই নয়, এর মধ্যে শিল্পী একটি ম্যাসেজ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তা হলো—দুটি হাত একে অপরকে ধরে রেখেছে, এর মানে হলো, আমরা যদি বিচ্ছিন্ন না থেকে এক থাকতে পারি তাহলে আমরা বিশ্বের এক শক্তিশালী জাতিতে পরিণত হতে পারবো। 

সাইফুল ইসলাম শ্রাবণ নামে এক পথচারী বলেন, এদিক দিয়ে যতবারই যাওয়া-আসা করি ততবার এই আর্টটা চোখে পড়ে। এত সুন্দরভাবে আরবি লেখা ফুটিয়ে তোলা যায়, আমি জানতাম না। আর এই ক্যালিগ্রাফিটা দেখে আমি যেটা বুজতে পারছি, সেটা হলো—পৃথিবীতে মুসলিম উম্মাহর ওপর যে নির্যাতন চলছে এ এসময়টায় আমরা একতাবদ্ধ না হলে আমরা মুসলিমরা আরও নির্যাতিত হবো। তাই ঐক্যের বিকল্প নাই। আমরা আবারও এক হয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলবো। এটাই ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে মোল্লা মোহাম্মদ হানিফ ভাই। তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইলো।

মেহেদী হাসান সৈকত/এএমকে