প্রেম করে বছর দেড়েক আগে বিয়ে করেন রবিনুর ও মমতা দম্পতি। বিয়ের পর কয়েক মাস পার না হতেই দুজনের ভালোবাসায় টান পড়ে। টুকটাক বিষয় নিয়ে সংসারে ফাটল দেখা দেয়। এরই মাঝে গর্ভে সন্তান ধারণ করেন মমতা। তবুও দাম্পত্য কলহ লেগে থাকায় উভয়ে সিদ্ধান্ত নেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আলাদা হয়ে যাবেন।

অবশেষে গর্ভে থাকা সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই অজানা ঠিকানায় পা বাড়ান মমতা। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নবজাতক শিশু রেখে পালিয়ে যান তিনি। অন্যদিকে, বিপদে পড়েন নবজাতকের বাবা রবিনুর। একপর্যায়ে নবজাতককে কাপড়ে মুড়িয়ে তিনি চলে যান থানায়।

রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) সকালে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নে ঘটনাটি ঘটে। পরে মমতা বেগমকে উদ্ধার এবং নবজাতক সন্তানের মা-বাবার মনোমালিন্য মিটিয়ে দিতে তৎপরতা হয়ে ওঠে পুলিশ। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সহযোগিতায় দিশেহারা রবিনুরের কোল থেকে মমতার কোলে ঠাঁই হয় কান্নারত নবজাতকের।

থানা-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, দেড় বছর আগে বিয়ে করেন রবিনুর মিয়া ও মমতা বেগম। বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেন আলাদা হয়ে যাবেন। তবে, বাধা হয়ে দাঁড়ায় অনাগত সন্তান। তাই তারা সন্তান জন্ম নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। রোববার সকাল ৭টার দিকে ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ছেলেসন্তান জন্ম দেন মমতা। জন্ম দেওয়ার ঘণ্টা তিনেক পর তিনি সেখান থেকে পালিয়ে যান।

এরপর স্বামী রবিনুর খোঁজাখুঁজি করে তাকে না পেয়ে বেলা ১১টার দিকে সন্তান নিয়ে থানায় যান। তখন নবজাতক কান্না করছিল। ওসির কাছে আকুতি জানান স্ত্রীকে খুঁজে বের করার। পরে পাঁচ ঘণ্টা ধরে থানা-পুলিশের দুটি দল সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে খুঁজে একটি সড়কের ধারে ওই নবজাতকের মাকে পান। এরপর তাকে এনে বুঝিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝামেলা মিটিয়ে বাসায় পৌঁছে দেয় পুলিশ।

বদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু হাসান কবির জানান, নবজাতকের জীবনের ঝুঁকির বিষয়টি চিন্তা করে ওই মায়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন তিনিসহ পুলিশের আরেকটি দল। বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সম্ভাব্য বিভিন্ন স্থানে মমতার খোঁজ করা হয়। একপর্যায়ে বদরগঞ্জ-রংপুর সড়কের চেংমারি নামক স্থানে এক নারীকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে যায়। পরে জিজ্ঞাসাবাদে নিশ্চিত হতে পারেন ওই নারীই হচ্ছেন নবজাতকের মা। সেখান থেকে থানায় এনে নবজাতককে মায়ের কোলে তুলে দেওয়া মাত্র কান্না থেমে যায়।

নবজাতকের মা মমতা বেগম বলেন, দেড় বছর আগে প্রেম করে আমরা দুজন বিয়ে করি। এরপর থেকে সামান্য বিষয় নিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। দাম্পত্য জীবনে অশান্তি সৃষ্টি হয়। সংসারে ফাটল দেখা দেয়। উভয়ে সিদ্ধান্ত নিই সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে আমরা আলাদা হয়ে যাব। তাই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান জন্ম দিয়ে সব মায়া ত্যাগ করে একাই বেরিয়ে পড়েছিলাম।

‘সন্তানের মমতা ভুলে যখন পালিয়ে এসেছি তখন ভাবছিলাম, অজানা কোথাও চলে যাব। কিন্তু থানার ওসি সাহেবের কারণে সেই ভাবনা থেকে সরে এসেছি। তিনি আমাদের অনেক বুঝিয়েছেন। আমরা তার কথায় নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছি। এখন সন্তানকে বড় করব। মরার আগপর্যন্ত আমরা দুজন কেউ কাউকে ছেড়ে যাব না।’

মমতার স্বামী রবিনুর মিয়া বলেন, বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত আমরা দুজন আলোচনা করে নিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে সেটা ছিল চরম ভুল। তবে, কখনো ভাবতে পারিনি আজকের মতো ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। সন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই স্ত্রী আমাকে ও ভূমিষ্ঠ সন্তানকে ছেড়ে চলে যাবে, তা বিশ্বাস হচ্ছিল না। ওসি সাহেবের চেষ্টায় এখন সব মনোমালিন্যের অবসান হয়েছে। আমরা আমাদের নিজেদের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি।

ওসি আবু হাসান কবির জানান, ওই দম্পতিকে বুঝিয়ে তাদের মধ্যে মনোমালিন্যের অবসান ঘটানো হয়েছে। তারা উভয়ে পুলিশের প্রতি ভরসা রেখে নবজাতককে নিয়ে নতুন উদ্যমে সংসার করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে, ওই দম্পতির অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের কারণে নবজাতকের জীবনের প্রথম ছয় ঘণ্টা কষ্টকর ছিল। এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

কিন্তু দুজনের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে এটি ঘটলেও শেষ পর্যন্ত তারা আবার একত্রিত হয়ে ঘরে ফেরায় আমরা আনন্দিত— বলেন তিনি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/পিএইচ