বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারি নুরুল আমিন চৌধুরী (আরমান), একই সঙ্গে তিনি বান্দরবান পৌরসভায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। স্থানীয় সরকার পৌরসভা আইন, ২০০৯-এর ৫ ধারায় পৌরসভা সরকারের একটি প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে স্বীকৃত। এমন একটি  প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বান্দরবান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে আসছেন বিগত ১৫ বছরের অধিক সময় ধরে।

একক ক্ষমতাবলে চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারির পদে থেকে বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যবসায়ীকে দিচ্ছেন চেম্বার অব কমার্সের ট্রেড সার্টিফিকেট।

ট্রেড সার্টিফিকেটে বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট বান্দরবান জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ক্য শৈ হ্লার স্বাক্ষর দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও সেক্রেটারি নুরুল আমিন চৌধুরী (আরমান) নিজের স্বাক্ষরের পাশাপাশি সংস্থাটির প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরও নিজে দিয়ে ট্রেড সার্টিফিকেট নবায়নসহ নতুন সার্টিফিকেট দিচ্ছেন চেম্বারের সদস্যদের।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল আমিন চৌধুরী (আরমান) বলেন, বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট ক্য শৈ হ্লা কোথায় আছেন—সে ব্যাপারে জানি না। তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টাও করেছি, শুনেছি বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। তিনি বলেন, অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসায়িক গুরুত্বপূর্ণ কাজ সমাধানের জন্য চেম্বারের ট্রেড সার্টিফিকেটের জন্য আমার কাছে এসেছেন। আমি তাদের ট্রেড সার্টিফিকেট দিয়েছি। যার টাকা বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে।

চেম্বার অব কমার্সের ট্রেড সার্টিফিকেটে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর নিজে দেওয়ার বিষয়টি তিনি প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করে বলেন, প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে আমাকে কোনো ক্ষমতা দেননি, তবে ট্রেড সার্টিফিকেট নিতে আসা ব্যবসায়ীদের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে আমি তাদের সার্টিফিকেট দিয়েছি। আপনি বললে আজ থেকে আর সার্টিফিকেট দেবো না। তিনি আরও বলেন, বান্দরবান চেম্বার অব কমার্স থেকে আমি কোনো বেতন-ভাতা গ্রহণ করি না, আমি শুধু বান্দরবান পৌরসভার হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা হিসেবে পৌরসভা হতে বেতন নিই। চেম্বারের সার্টিফিকেট প্রদানে বিভিন্ন অযুহাতে অতিরিক্ত টাকা গ্রহণের অভিযোগের বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী ঠিকাদার বলেন, জেলা সদরসহ নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদমসহ উপজেলার কয়েকজন ব্যবসায়ীকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জরুরিভাবে তিনি (আরমান) বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের ট্রেড সার্টিফিকেট দিয়েছেন।

বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের ট্রেড সার্টিফিকেটের গুরুত্ব এত বেশি হওয়ার কারণ অনুসন্ধান করতে গেলে জানা যায়, সাধারণত বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রকৌশল বিভাগের বিভিন্ন টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের এই ট্রেড সার্টিফিকেট প্রদান বাধ্যতামূলক। 

বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা পরিষদের প্রকৌশল বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এই নিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে এবং জেলা পরিষদের যেকোনো ঠিকাদারি কাজে চেম্বার অব কমার্সের সার্টিফিকেট দিতে হবে।

বর্তমানে চেম্বারের লাইসেন্সে প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর সেক্রেটারি প্রদান করছেন। এমন সার্টিফিকেট কীভাবে গ্রহণ করছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নুরুল আমিন চৌধুরী (আরমান) কোন ক্ষমতায় প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষর নিজে দিচ্ছেন তা আমরা জানি না, তবে এ ধরনের সার্টিফিকেট পরবর্তীতে আর গ্রহণ না করার বিষয়ে তিনি প্রতিবেদককে আশ্বস্ত করেন।

এ বিষয়ে বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট বান্দরবান জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লাকের ফোনে কল করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ থাকায় বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

চেম্বার অব কমার্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট শফিকুর রহমান বলেন, আরমান নিয়মিত চেম্বার অব কমার্স হতে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেন।
ঠিকাদারদের একক স্বাক্ষরে ট্রেড সার্টিফিকেট দেওয়ার বিষয়ে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, আমাকে জানানো হয়নি। প্রেসিডেন্টের অবর্তমানে তিনি কোনোভাবেই তার স্বাক্ষর দিতে পারেন না, এটা আইনগতভাবে অন্যায়।

বান্দরবান চেম্বার অব কমার্সের পরিচালক একেএম জাহাঙ্গীর বলেন, উনি পৌরসভার চাকরির পাশাপাশি চেম্বার অব কমার্সে খণ্ডকালীন কাজ করেন এবং তাকে চেম্বার অব কমার্স হতে প্রতিমাসে সম্মানীও প্রদান করা হয়।

তিনি আরও বলেন, বান্দরবান পৌরসভার হিসাবরক্ষক কর্মকর্তা হয়েও তিনি জেলা চেম্বার অব কমার্সের সেক্রেটারিসহ আছেন এপেক্স ক্লাবের ন্যাশনাল সার্ভিস ডাইরেক্টর হিসেবে। এ ছাড়াও তিনি লায়ন্স ক্লাবসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন। বছরে ইউরোপের ৪, ৫টি দেশে তিনি ভ্রমণ করেন, এসব সংগঠনের পক্ষ হতে।

অনুসন্ধানে উঠে আসে, বিগত ২০০৬ সালে বান্দরবান পৌরসভার কর্মচারীদের সাইকেল ক্রয়-সংক্রান্ত একটি অনিয়ম তদন্ত প্রমাণিত হওয়ায় স্থানীয় সরকার বিভাগের তৎকালীন সিনিয়র সহকারী সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খান স্বাক্ষরিত একটি পত্রে তাকে চাকরি হতে সাময়িক বরখাস্ত করে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও ‘ভৌতিক হাতের ইশারা’য় তা বাস্তবায়ন হয়নি।

সে সময়ের (২০০৬ সালের ১০ মার্চ) জাতীয় পত্রিকা আজকের কাগজ, সুপ্রভাত বাংলাদেশ, আঞ্চলিক পত্রিকা গিরিদর্পণসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকায়  তার এই বরখাস্তের খবর প্রকাশিত হয়।

দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পরেও হয়েছে কয়েক দফা প্রমোশন। এত অনিয়ম আর স্বেচ্ছাচারী আচরণের পরেও তিনি আছেন বহাল তবিয়তে। নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি করে কামিয়েছেন অবৈধ কালো টাকা।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার উপপরিচালক এবং বান্দরবান পৌরসভার প্রধান নির্বাহী জাহিদ ইকবাল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পৌরসভার দায়িত্বপূর্ণ সময়ে উনি অন্য কোনো সংস্থার কাজ করার কোনো সুযোগ নেই, এ বিষয়ে আমি অবগত নই, তার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখা হবে এবং ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

এএমকে