দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ফরিদা পারভীনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। গত দুই বছর অধ্যক্ষ থাকাকালে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। গত ২০ আগস্ট শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে অবসরে যাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে অবসরে যাওয়ার পর থেকেই তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মের তথ্য সামনে আসতে থাকে। এরপর কলেজের শিক্ষকরা হিসাব শাখা থেকে গত কয়েক বছরের ভাউচার ও চেক বই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেন। পরে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফরিদা পারভীনের আর্থিক দুর্নীতি তদন্তে কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল মান্নানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিটি গঠন করেন। কমিটিকে আগামী ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে কার্যক্রম সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।

অভিযুক্ত ফরিদা পারভীন ১৯৯৩ সালে ওই কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। ২০২০ সালে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক এবং ২০২২ সালের আগস্টে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ১৯৯৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কোথাও কোনো বদলি ছাড়া একই কলেজে দায়িত্ব পালন করেছেন।

তদন্ত কমিটির প্রধান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কয়েক বছর কলেজে কোনো ধরনের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়নি। কিন্তু ক্রীড়া অনুষ্ঠান বাবদ কলেজের ফান্ড থেকে বিভিন্ন সময়ে ৪টি চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ টাকা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠানোর কার্যক্রম ২০২১ সাল থেকে বন্ধ রয়েছে। অথচ ২০২১ সালের পর থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত এসএমএস ফি বাবদ সোয়া ৭ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কলেজে কোনো যানবাহন না থাকলেও যানবাহন বাবদ অর্থ উত্তোলন করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান আরও বলেন, কলেজের আবাসিক শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য ফরিদা ইয়াসমিন নামে এক চিকিৎসককে মাসিক ৫ হাজার টাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। ২০২০ সালের মার্চের পর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু চলতি বছরের মে মাসে চিকিৎসকের ভাতা বাবদ ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন তিনি। এছাড়া গত বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালনের জন্য তিনি পৌনে ২ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। অথচ একটি ব্যানার করা ছাড়া আর কোনো খরচ করা হয়নি। এভাবে গত দুই বছরে শুধু বিবিধ অ্যাকাউন্ট থেকে উত্তোলন করেছেন প্রায় ৩০ লাখ টাকা। অথচ এসব টাকার ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই।

তদন্ত কমিটির সদস্য নূর-এ-আলম সিদ্দিকী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২০২২ সালের ১১ আগস্ট ফরিদা পারভীনকে অধ্যক্ষের দায়িত্ব হস্তান্তরকালে সর্বমোট ৩ কোটি ৪০ লাখ ৫৯ হাজার ৮ টাকা লিখিত বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি জনতা ব্যাংকের পাঠ উন্নয়ন ফান্ড অ্যাকাউন্ট থেকে ৩ লাখ ৩৪ হাজার ৫০০, সাধারণ তহবিল ফান্ড থেকে ১৪ লাখ ৫৬ হাজার, পরিবহন-যাতায়াত ফান্ড থেকে ১৯ হাজার ৫০০সহ মোট ১৮ লাখ ৬ হাজার ৫০১ টাকা উত্তোলন করে তিনটি অ্যাকাউন্টই বন্ধ করে দেন। এছাড়া একইভাবে সোনালী ব্যাংকে বাড়িভাড়া ফান্ড থেকে ৯১ হাজার  ২৩৮ ও উন্নয়ন ফান্ড থেকে ১১ হাজার ৭৪৯ টাকা উত্তোলন করে এই অ্যাকাউন্ট দুটিও বন্ধ করে দেন। বর্তমানে এই অ্যাকাউন্টগুলোর কলেজে আর কোনো অস্তিত্ব নেই।

কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আবেদুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, একজন অধ্যক্ষ এতটা দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারেন, এটা নিজে না দেখলে বিশ্বাসই করতাম না। আমার নামে চেক ইস্যু করে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে অথচ আমি জানিই না।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযুক্ত ফরিদা পারভীনকে ফোন দেওয়া হলে তিনি অসুস্থ এবং এ বিষয়ে এখন কোনো মন্তব্য করতে রাজি নন বলে ফোন রেখে দেন।

জানতে চাইলে কলেজের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. আশরাফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করছি। এখন পর্যন্ত যতটুকু দেখেছি, ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোথাও নিয়ম মানা হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে।

ইমরান আলী সোহাগ/এসকেডি