বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পুলিশের ছোররা গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন দিনাজপুর শহরের রাজবাটি এলাকার ট্রাক্টর শ্রমিক আব্দুর রশিদ। চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন হাসপাতালে। সংসারের অভাব অনটন, চিকিৎসা ও নবজাতকের ভরণপোষণ নিয়ে দুশ্চিন্তায় এক আত্মীয়র কাছে ৩ দিনের নবজাতক দত্তক দেন রশিদ-রতনা দম্পতি।

‘নবজাতককে বিক্রি করে স্বামীর চিকিৎসা করাচ্ছেন স্ত্রী’- এমন শিরোনামে গতকাল সোমবার বিভিন্ন মিডিয়ায় সংবাদ প্রকাশিত হলে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েন রশিদ ও রতনা। বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থী এবং দিনাজপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল আহমেদের নজরে আসে। পরে গতকাল সোমবার বিকেল ৫টার দিকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিশুটির মা ও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মকর্তা শিশুটিকে ফেরত আনতে কুড়িগ্রাম শহরের ক্লিনিক পাড়া গ্রামে যান। সেখান থেকে রাত ১টার দিকে নবজাতককে জন্মদাতা মা-বাবার কোলে তুলে দেওয়া হয়।

শিশুটির বাবা আব্দুর রশিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার স্ত্রীকে গত ৪ আগস্ট দিনাজপুর সদর হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়ার পথে আমি পুলিশের গুলিতে আহত হই। পরে হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরি। বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তিন দিন পর দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হই। এর মধ্যে আমার সন্তান জন্ম নেয়। তখন আমি হাসপাতালে। একদিকে আমার চিকিৎসা খরচ, অন্যদিকে আরেক সন্তান জন্ম নেয়। আগের একটি দুই বছরের কন্যা সন্তান আছে। সব মিলে বড় একটা অসুবিধার মধ্যে পড়ি। পরে পরিচিত এক আত্মীয়র কাছে আমার তিন দিন বয়সী কন্যা সন্তানকে দত্তক দেই। তারা আমাদের চিকিৎসার জন্য ২৫ হাজার টাকা দেন। যদি চিকিৎসার জন্য আরও খরচের প্রয়োজন হয় তারা দেবেন বলে জানান। 

তিনি বলেন, বিষয়টি বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা ও প্রশাসন অবগত হলে তারা আমার সন্তানকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিতে চায় এবং বলে আমার যাবতীয় চিকিৎসা খরচ তারা বহন করবে। কিন্তু আমি ও আমার স্ত্রী তাতে রাজি ছিলাম না। পরে তারা আমাদের অনুরোধ করলে আমরা রাজি হই। রাতের মধ্যে আমার সন্তানকে কোলে তুলে দেন তারা। মেয়েকে কোলে নিয়ে মনে হচ্ছে গুলিবিদ্ধ হয়ে যে কষ্ট পেয়েছিলাম, মেয়েকে কাছে পেয়ে সে কষ্ট ভুলে গেছি। আপনারা দোয়া করবেন আমার সন্তানের জন্য। 

শিশুটির মা রতনা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছাত্ররা ও প্রশাসনের ভাইয়েরা মিলে আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি খুশি। অভাব-অনটনের কথা ভেবে বাচ্চাকে আত্মীয়ের কাছে দিয়েছিলাম। পরে খুব খারাপ লাগছে। বাচ্চাকে ফিরে পেয়ে এখন ভালো লাগছে।

দিনাজপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি একরামুল হক আবির ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা শুরু থেকে আব্দুর রশিদ ভাইয়ের চিকিৎসার খোঁজখবর রাখছিলাম। দুই দিন আগে আমরা বিষয়টি অবগত হই যে বাচ্চা হস্তান্তর করছে আব্দুর রশিদ ভাই। আমার খোঁজ নিয়ে জানতে পারি খুব কাছের স্বজনের কাছে বাচ্চাটি হস্তান্তর করছে। পরে আমরা রশিদ ভাই ও রন্তা ভাবিকে বলি যেহেতু বাচ্চাটি হস্তান্তরের সময় কিছু আর্থিক সহায়তা নেওয়া হয়েছে আমরা সেটি দিয়ে দিচ্ছি। আপনার বাচ্চাটিকে নিয়ে আসেন। পরে আমরা একটি টিম কুড়িগ্রাম পাঠাই। সেখানে গিয়ে জানতে পারি বাচ্চাটি সেখানে ভালো থাকবে। সেখান থেকে আমরা আব্দুর রশিদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করি যে আপনার বাচ্চাটিকে ফেরত নেবেন কি না। তারা জানান পরিবারের অভাব-অনটনে বাচ্চাটা ওদের কাছে ভালো থাকবে। 

তিনি বলেন, পরে একটি গণমাধ্যম ভুল তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রচার করলে সরকারের উপদেষ্টাদের পক্ষ থেকে চাপ আসে। পরে প্রশাসন আমাদের অবগত করে যে বাচ্চাটি তাদের বাবা মায়ের কাছে ফেরত দিতে হবে। সদরের ইউএনও স্যারের নির্দেশে শিশুটির মাসহ আমাদের একটা টিম কুড়িগ্রাম যায়। শিশুটি নিয়ে যখন চলে আসবে তখন ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। যে মা গত এক মাস বাচ্চাটাকে লালন পালন করেছেন আকিকা করে বাচ্চার নামও রেখেছেন তানহা বেগম, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। স্যালাইন লাগাতে হয়েছে। আমরা বলেছি শিশুটি বড় হলে দুই পরিবারের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে।

দিনাজপুর এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক মাহাবুব মোর্শেদ জানান, রশিদের শরীরে আরও গুলি আছে। প্রস্রাবের জন্য ড্রেন করে দেওয়া হয়েছে নাভি দিয়ে। এখন পর্যন্ত তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বহন করেছে। সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকেও আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। সার্বক্ষণিক তার খেয়াল রাখা হচ্ছে। 

ইমরান আলী সোহাগ/আরএআর