গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ে জাল সার্টিফিকেট ব্যবহার করে একাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় হয়েছে নানা অনিয়ম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— প্রতিষ্ঠান-সভাপতির স্বাক্ষর জাল করা, ডিজির প্রতিনিধির অনুপস্থিতিতে পরীক্ষা গ্রহণ এবং পরীক্ষার শর্তপূরণ করতে ভুয়া পরীক্ষার্থী দেখানো।

কেবল শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মই নয়, পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকরা বছরের পর বছর ধরে তুলছেন বেতন। এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে স্থানীয়ভাবে প্রতিবাদ, আন্দোলন এবং অভিযোগ দায়ের করা হলেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।

বেশ কয়েকবার বিক্ষোভ ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হলেও অভিযুক্ত শিক্ষক, অধ্যক্ষ এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মনোজগতেও কোনো পরিবর্তন আসেনি। বিশেষ করে বর্তমান অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামান রোকনের নীরব ভূমিকা পরিস্থিতি আরও গুরুতর করে তুলেছে। যদিও তিনি বিষয়টি সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত, তবুও অজ্ঞাত কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির এসব অবৈধ নিয়োগ, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন আব্দুর রহিম ও মেহেদী বাবুসহ স্থানীয় পাঁচজন। যার একটি অভিযোগের কপিসহ বেশ কয়েকটি নথিপত্র এসেছে ঢাকা পোস্টের হাতে।

গত ১৮ জুলাই জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বরাবর দায়ের করা অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, কলেজের সাচিবিক বিদ্যা বিভাগের প্রভাষক সাহানাজ বেগম শম্পা ২০০৩ সালের ১০ নভেম্বর গভর্নিং বডির ৪৭তম সভায় অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বৈধ নিয়োগে অন্তত তিনজন পরীক্ষার্থীর উপস্থিতির শর্ত থাকলেও উপস্থিত ছিলেন দুজন। এ ছাড়া ওই নিয়োগ পরীক্ষায় কোনো বিশেষজ্ঞ ছাড়াই তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহিনূর আলম নিজেই পরীক্ষা নেন। যা বিধিবহির্ভূত।

পরীক্ষা সংক্রান্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮.১ বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো বৈধ নিয়োগে কমপক্ষে তিনজন পরীক্ষার্থীর অংশগ্রহণ থাকতে হবে। কিন্তু কঞ্চিপাড়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের ২০০৩ সালের ৯ নভেম্বরের নিয়োগ সংক্রান্ত এক রেজুলেশনে সাচিবিক বিদ্যা প্রভাষক পদের ওই পরীক্ষায় সাহানাজ বেগম শম্পা ও জুলফিকার আলীসহ দুজন পরীক্ষার্থীর নাম দেখা যায়। একই তারিখের ডিজির প্রতিনিধি স্বাক্ষরিত সিএস কপির ফলাফল শিটেও ওই দুই পরীক্ষার্থীর ফলই রয়েছে। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮.১ বিধিবহির্ভূত।

এদিকে গভর্নিং বডির ৪৬তম সভার রেজুলেশনে দেখা যায়, তৎকালীন নতুন নিয়োগপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শামীম মাহবুব ওই বছরের ১৭ নভেম্বর পর্যন্ত জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) প্রশিক্ষণে থাকার কারণে ২৬ অক্টোবর গভর্নিং বডির রেজুলেশনে তৎকালীন শিক্ষক প্রতিনিধি এবং ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের প্রভাষক শাহিনূর আলমকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।

ওই রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়, অধ্যক্ষ ১৭ নভেম্বর প্রশিক্ষণ শেষ করে এসে দায়িত্বভার গ্রহণ করার একদিন পর নিয়োগকার্য সম্পাদন করবেন। কিন্তু অধ্যক্ষ ফেরার এক সপ্তাহ আগেই তড়িঘড়ি করে ১০ নভেম্বর গোপনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শাহিনূর আলম নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পাদন করেন। যা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের এখতিয়ার ও বিধিবহির্ভূত। শুধু তা-ই নয়, সাহানাজ বেগম শম্পার নিয়োগ সম্পাদন রেজুলেশনে প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সভাপতি বেগম রওশন এরশাদেরও (সাবেক এমপি) স্বাক্ষর ছিল না।

অভিযোগে উল্লিখিত ওই কলেজের আরেক অভিযুক্ত শিক্ষকের নাম ইসরাত জাহান চৌধুরী। তিনি ২০০৪ সালের ১৫ জুন ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তার ইনডেস্ক নম্বর এন-৩১০০৫৮৫। তার নিয়োগ পরীক্ষাতেও নিয়োগবিধি অনুযায়ী পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর উপস্থিতির শর্ত পূরণ করা হয়নি। ২০২৪ সালের ১৫ জুন ওই নিয়োগ পরীক্ষায় ইসরাত জাহান চৌধুরী পরীক্ষার্থী হিসেবে একাই উপস্থিত ছিলেন।

জানা যায়, ২০০৪ সালের ১৫ জুন ওই নিয়োগ পরীক্ষা-সংক্রান্ত রেজুলেশনে পরীক্ষার্থী হিসেবে আবেদনকারীর সংখ্যা তিনজনের কথা বলা হলেও ইসরাত জাহান চৌধুরী ছাড়া অপর দুজন পরীক্ষার্থীকে অনুপস্থিত দাবি করা হয়। একই সঙ্গে রেজুলেশনে উল্লেখ করা হয়, পরপর তিনবার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরও মাত্র একজন প্রার্থী উপস্থিত হওয়ায় ইসরাত জাহান চৌধুরীকে ইতিহাস-৩ এর প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হলো।

কিন্তু ইসরাত জাহান চৌধুরীর ওই নিয়োগের সুপারিশ ডিজির নিকট গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় জালিয়াতির আশ্রয় নেন অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামান। তিনি তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক জহুরুল ইসলামের সহায়তায় রেজুলেশনের দ্বিতীয় পাতা এবং রেজুলেশন বইয়ের ১১ নম্বর পাতা পরিবর্তন করে পরীক্ষায় একজন পরীক্ষার্থীর স্থলে ভুয়া তিনজন প্রার্থী দেখান। যেখানে ইসরাত জাহান চৌধুরী ছাড়াও পরীক্ষার্থী হিসেবে নুহু আলামিন ও হৃষিকেশের নাম উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি রেজুলেশনে সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে এমপিওভুক্ত করানো হয়।

অভিযুক্ত অপর শিক্ষক কলেজের আইসিটি বিভাগের প্রভাষক তৌহিদা বেগম। তিনি ২০০২ সালে আইসিটি সার্টিফিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে ছয় মাসের ‘নট্রামস’ এর সার্টিফিকেটের কথা উল্লেখ থাকলেও তিনি একটি জাল সার্টিফিকেট প্রদান করে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এদিকে, চলতি বছরের ৩০ জুলাই গাইবান্ধার জেলা প্রশাসক বরাবর দায়ের করা অপর একটি অভিযোগে ওই কলেজের যুক্তিবিদ্যা বিভাগের প্রভাষক কামরুল লায়লা জাল সনদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়। কামরুল লায়লার ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধনের জাল সনদের সিরিয়াল নম্বর-৯২৫৪৯৯।

জানা যায়, প্রতিষ্ঠানটির বিজ্ঞান বিভাগে কাম্য (নির্দিষ্ট সংখ্যক) শিক্ষার্থী না থাকলেও ওই বিভাগের সকল শিক্ষক বছরের পর বছর ধরে বেতন তুলছেন! এ সংক্রান্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮.৪ বিধিতে বলা হয়েছে, কোনো কলেজের শাখা বা বিভাগ খোলা এবং চলমান থাকার জন্য ওই বিভাগে ‍ন্যূনতম ২৫ জন শিক্ষার্থী থাকা আবশ্যক। অথচ কলেজটি এ শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ১৬ জন। যা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬.৩ বিধিবহির্ভূত। এ ছাড়া বিভাগ টিকিয়ে রাখার জন্য ন্যূনতম পাসের হার থাকার কথা ৭০ ভাগ। কিন্তু ২০২৩ সালে কলেজটিতে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে পাস করেন মাত্র তিনজন।

অভিযোগ উঠেছে, প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়মের বিষয়ে বর্তমান অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামান অবগত থাকলেও প্রতিষ্ঠানপ্রধান হিসেবে তিনি কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। কারণ, তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক। ফুলছড়ি উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক এবং ওই আসনের প্রয়াত এমপি ফজলে রাব্বীর আশীর্বাদপুষ্ট রোকন তিনি। ফজলে রাব্বীর মৃত্যুর পর সদ্য সাবেক সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান রিপনেরও আস্থাভাজন হন। ফলে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ উঠলেও পরোয়া করেননি। এ কারণে অবৈধভাবে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের ভরসা ও আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামান।

সেই প্রভাবে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নির্দেশনাও তোয়াক্কা করছেন না এই অধ্যক্ষ। কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক রেহেনা ইয়াসমিনের সার্টিফিকেট জালিয়াতির বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে অধ্যক্ষকে নির্দেশ দেয় এনটিআরসিএ কর্তৃপক্ষ। এনটিআরসিএ’র সহকারী পরিচালক (পরীক্ষা মূল্যায়ন ও প্রত্যয়ন) তাজুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গত ২১ মে একটি পত্রে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। পত্রে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে এনটিআরসিএকে অবহিত করতেও বলা হয়। কিন্তু পত্র প্রেরণের চার মাস চললেও কোনো ব্যবস্থা নেননি অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামান।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক ইসরাত জাহান চৌধুরী মুঠোফোনে বলেন, ‘আমি ২০০৪ সালে যোগদান করি। ২০১৯ সালে আমার বেতন হয়। তার আগে বিনা পারিশ্রমিকে ১৫ বছর ক্লাস নিয়েছি। এতদিন পরে এসে যদি বলে আমার নিয়োগ অবৈধ, তাহলে এর দায়ভার আমার নয়, কলেজ কর্তৃপক্ষের। এসব আমার জানারও কথা নয়।’

আইসিটি বিভাগের অভিযুক্ত প্রভাষক তৌহিদা বেগম বলেন, ‘বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আইসিটি বিষয়ে একটি ট্রেনিং সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছিল। সেটি আমি দিয়েছি। কিন্তু আমি কীভাবে জানব সেটি জাল নাকি সঠিক? আজ যদি সেটি জাল প্রমাণিত হয় তাহলে এর দায়ভার ওই (ট্রেনিং সেন্টার) প্রতিষ্ঠানের। আমার সার্টিফিকেট যদি জাল হয় তাহলে ওই সময়ে সার্টিফিকেট নিয়ে যারাই চাকরি নিয়েছেন সবারটাই জাল।’

মন্তব্য জানতে কঞ্চিপাড়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান অধ্যক্ষ এটিএম রাশেদুজ্জামানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার রোকসানা বেগম মোবাইল ফোনে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অভিযোগ পেয়েছি। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে যাব।’

কঞ্চিপাড়া ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের বর্তমান সভাপতি ও ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জগৎবন্ধু মন্ডল মোবাইল ফোনে বলেন, ‘অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত হয়েছি। আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জেলা প্রশাসক মহোদয়ের কাছেও অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে ওই প্রতিষ্ঠানে নানা অভিযোগ রয়েছে। অবশ্যই সেগুলো খতিয়ে দেখব।’

আরকে