কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ায় গাছের ডালে ঝুলিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় নির্যাতন করে মো. সাজ্জাদ হোসেন (২২) নামে এক যুবককে হত্যার ঘটনায় করা মামলার এক সপ্তাহ পার হলেও এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছেন অভিযুক্ত আসামিরা। এতদিনে একজনও গ্রেপ্তার না হওয়ায় ছেলে হত্যার বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সাজ্জাদের মা হাসেনা বেগম।

ছেলে হারানোর শোকে কাতর পঞ্চাশোর্ধ এই মায়ের কান্না থামছে না কিছুতেই। ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় হাসেনা বেগমের দাবি কেবল একটাই, যারা তার ছেলেকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের যেন ফাঁসি হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একজন আসামিও গ্রেপ্তার না হওয়ায় এ আশাতেও আবছা ছায়া দেখছেন তিনি।

বৃহস্পতিবার (০৫ সেপ্টেম্বর) রাতে ঢাকা পোস্টকে এসব কথা বলেন নিহত সাজ্জাদের মা হাসেনা বেগম।

তিনি বলেন, আমার ছেলে একটি মাদ্রাসা থেকে দাখিল পরীক্ষা দিয়েছিল। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে রংমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ করত। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিল সাজ্জাদ। ঘাতকের দল আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করল। মামলা করার এতদিন পরেও একজনকেও ধরতে পারল না পুলিশ। আমি কি আমার ছেলে হত্যার বিচার পাব?

তবে আসামিরা শীঘ্রই ধরা পড়বে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ব্রাহ্মণপাড়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহাবুর আলম। তিনি বলেন, সাজ্জাদকে নির্যাতনের সাত দিন পর মারা যাওয়ায় ঘাতকরা অনেক লম্বা সময় পেয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। তাদের সবার মোবাইল ফোন বন্ধ। আমরা অন্য কৌশলে অগ্রসর হচ্ছি। তার ওপর এখন চারদিকে বন্যার পানি। আমি গতকাল রাতেও পার্শ্ববর্তী দেবিদ্বার উপজেলায় অভিযান চালিয়েছি। প্রতিদিন নতুন নতুন সোর্স পাচ্ছি। আসামিদের খুব কাছাকাছি আছি আমরা। শীঘ্রই সবাইকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

স্থানীয় বাসিন্দা এবং মামলার বরাত দিয়ে জানা গেছে, গত ২২ আগস্ট দুপুরে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার দক্ষিণ চান্দলা এলাকার আব্দুস সাত্তারের ছেলে সাজ্জাদ হোসেন এবং একই এলাকার মাহবুবের ছেলে সাগরকে বাড়ি থেকে কাজের কথা বলে ডেকে নেন ওই এলাকার আজিজ টেইলরের ছেলে আমিনুল হক সুজন (মামলার ৩ নম্বর আসামি), একই এলাকার রেনু মিয়ার ছেলে হৃদয়সহ আরও কয়েকজন। পরে চান্দলা এলাকার আনোয়ার মাস্টারের বাড়ি সংলগ্ন কাঠের বাগানে একটি গাছে রশি দিয়ে ঝুলিয়ে সাজ্জাদ ও সাগরকে মারধর করা হয়। ওই এলাকার কবির খন্দকারের দোকানে চুরির অপবাদ দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় তাদের পাশবিক নির্যাতন করেন চান্দলা এলাকার শরাফত আলীর ছেলে রাসেল, একই এলাকার মৃত শরাফত আলীর ছেলে আক্তার হোসেন, আজিজ টেইলরের ছেলে আমিনুল হক সুজন, ফুল মিয়ার ছেলে রেজাউল, মৃত বজলু খন্দকারের ছেলে কবির খন্দকার, রেনু মিয়ার ছেলে হৃদয়, আব্দুর রহমানের ছেলে আমির হোসেনসহ অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জন। সাজ্জাদ ও সাগরকে ধরে এনে নির্যাতনের নির্দেশ দেন ওই এলাকার আব্দুল ওয়াছেকের ছেলে আতাউর রহমান।

পাশবিক ওই নির্যাতনের খবর পেয়ে সাজ্জাদ ও সাগরের স্বজনরা ঘটনাস্থলে গিয়ে নির্যাতনের দৃশ্য মোবাইল ফোনে ধারণ করতে গেলে তাদেরও হেনস্তা করেন অভিযুক্তরা। পরে নির্মম নির্যাতনে ভুক্তভোগী দুই যুবক অজ্ঞান হয়ে পড়লে নির্যাতনকারীরা ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন।

পরে মুমূর্ষু অবস্থায় দুইজনকে উদ্ধার করে প্রথমে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। সেখান থেকে চিকিৎসক তাদের কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠান। সেখানে দুইজনকে ভর্তি করা হলে সাজ্জাদের অবস্থা বেগতিক দেখে চিকিৎসক তাকে আবার কুমিল্লা সিডি প্যাথ হাসপাতালে ভর্তি করতে বলেন। সেখানে ছয় দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ২৯ আগস্ট বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

এ ঘটনায় নিহত সাজ্জাদের মা হাসেনা বেগম বাদী হয়ে আটজনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণপাড়া থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ওই মামলার একসপ্তাহ পার হলেও আসামিদের একজনকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

ব্রাহ্মণপাড়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম আতিক উল্যাহ বলেন, ঘটনার পর থেকে ব্রাহ্মণপাড়ায় ভয়াবহ বন্যা চলছে। আমরা জড়িতদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রেখেছি। ঘটনায় জড়িত সবাই স্ব পরিবারে গা ঢাকা দিয়েছেন। আমরা তাদের আইনের আওতায় এনে ছাড়ব। তাছাড়া ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে কেউই পুলিশকে বিষয়টি জানায়নি। মারা যাওয়ার পরদিন মামলা করতে আছে নিহত সাজ্জাদের পরিবার। তখন আমরা এ ঘটনা জানতে পারি।

আরিফ আজগর/এফআরএস