বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন
পায়ে গুলি নিয়ে কাতরাচ্ছেন বাবু মিয়া
ষাটোর্ধ্ব বয়সী বাবু মিয়া। পেশায় তিনি সবজি ব্যবসায়ী। প্রতিদিন সকাল হলেই ছুটে যেতেন সিটি বাজারে সবজির দোকানে। যা আয় হতো তাই দিয়ে টেনেটুনে চলতো অভাবের সংসার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। এখন পায়ে গুলি নিয়ে বিছানায় কাতরাচ্ছেন। অর্থাভাবে তার উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা না হওয়াতে পঙ্গুত্বের আশঙ্কায় দিন কাটছে পরিবারের সদস্যদের। এখন নিজের অজানা ভবিষ্যৎ ভেবে ভেবে অঝোরে কাঁদছেন অসহায় বাবু মিয়া।
রংপুর মহানগরীর জুম্মাপাড়া এলাকার বাসিন্দা বাবু মিয়া। ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এখনো তার পায়ের ভেতরে একাধিক বুলেট রয়েছে। থেমে থেমে পা থেকে রক্ত, পুঁজ ঝড়ছে। ব্যথা আর তীব্র যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন তিনি। চোখের দুই কোণ দিয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। দিনভর স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউয়েরা সেবা দিয়ে আসছেন আহত বাবু মিয়াকে।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে হাঁটা-চলা করতে পারছেন না বাবু মিয়া। অন্যের কাঁধে ভর করে হাঁটাহাঁটির চেষ্টা করছেন। সবজি বিক্রি করে যে বাবুর সংসার চলতো, এখন তিনিই অন্যের সহায়তার জন্য তাকিয়ে আছেন। অর্থের অভাবে ওষুধ কিনে খেতে এবং চিকিৎসা করতে না পারায় দিন দিন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের শঙ্কা- যে কোনো সময় পচে যেতে পারে বাবু মিয়ার পা। এতে করে তিনি শেষ বয়সে পঙ্গুত্ববরণ করতে পারেন।
জানা যায়, গত ১৯ জুলাই বিকেলে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রংপুর সিটি বাজার এলাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়। পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ চলে। ছাত্র-জনতাকে দমাতে পুলিশ এপিসি গাড়ি থেকে গুলি ছোড়ে এবং ছোররা গুলি, রাবার বুলেটসহ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে।
উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি করে দোকান বন্ধ করেন সিটি বাজারের সবজি বিক্রেতা বাবু মিয়া। এ সময় তিনি হঠাৎ পায়ে আঘাত অনুভব করেন এবং দেখেন পা থেকে রক্ত ঝড়ছে। পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে তিনি পায়ে ব্যথা নিয়েই দৌড়ে পালিয়ে যান। এরপর বাবু মিয়া বাসায় এসে দেখতে পান তার পায়ে গুলি লেগেছে। পরদিন তিনি রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। চিকিৎসক তার পা থেকে দুটি গুলি বের করে দিয়ে ওষুধ লিখে দেন। বাবু মিয়ার পায়ের গভীরে আরও কয়েকটি গুলি রয়েছে, যা বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে অপসারণ করা সম্ভব বলে চিকিৎসক জানান।
হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফেরার পর দীর্ঘ প্রায় ৪৬ দিন ধরে বিছানায় শুয়ে দিন কাটছে বাবু মিয়ার। তার পরিবারে স্ত্রী, তিন ছেলে, ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি রয়েছে। ছেলেরা দিনমজুর হওয়ায় বাবার পায়ের অস্ত্রোপচার ও ওষুধ কিনে খাওয়ানোর অর্থ যোগাড় করতে পারছেন না। তাই ধীরে ধীরে বাবু মিয়ার পায়ের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা এলাকার কিছু বিত্তবানদের কাছ থেকে সহযোগিতা নিয়ে বাবু মিয়াকে ওষুধ কিনে খাওয়াচ্ছেন।
গুলিবিদ্ধ বাবু মিয়া বলেন, আমি তো আন্দোলনে ছিলাম না। ছাত্র ও পুলিশের গন্ডগোল লেগে গেল। আমি এমন পরিস্থিতি দেখে দোকান বন্ধ করছিলাম। হঠাৎ দেখি আমার পায়ে রক্ত ঝরতে থাকে ও ব্যথা শুরু হয়। আমি গুলি লাগার পর দৌড় দিয়ে আত্মরক্ষা করেছি। রাতে ব্যথা বাড়লে, পরের দিন মেডিকেলে যাই। সেখানে অপারেশন করে কয়েকটি গুলি বের করে এবং এখনও কিছু গুলি পায়ের ভেতরে রয়েছে। দিনভর পা ব্যাথা করে, হাঁটতে পারি না। কবে আবার সুস্থ্য হয়ে বাজারে যেতে পারবো এই চিন্তা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
বাবু মিয়ার ছেলে আশরাফুল হোসেন বলেন, বাবার পা থেকে দুইটা গুলি বের করা হয়েছে। বাকিগুলো পায়ের বেশি ভেতরে থাকায় চিকিৎসকরা বের করেননি। মেডিকেল থেকে বলছিল যেসব ওষুধ লেখা হয়েছে সেগুলো খেলে গুলিগুলো পা থেকে বের হয়ে যাবে। কিন্তু গুলি তো বের হয়নি বরং এখন পায়ের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। চিকিৎসকরা বলছেন- বাহিরে বাবার অপারেশন করালে অনেক টাকা প্রয়োজন। ওষুধপত্রের অনেক খরচ রয়েছে। সেজন্য আমি বিত্তবানদের কাছে আর্থিক সহযোগিতা চাই।
পুত্রবধূ মৌসুমী আক্তার বলেন, আমার শ্বশুরের পা থেকে রক্ত, পুঁজ বের হচ্ছে। সারাদিন সেই পা মুছতে আমাদের দিন কাটে। উনার আয় সংসারের কাজে লাগত। কিন্তু এখন তিনি কাজ করতে না পারায় টাকা-পয়সার অনেক সমস্যা হয়েছে। তার ওপর দামি দামি ওষুধ খাওয়াতে হচ্ছে। আমি চাই সরকার যেন দ্রুত আমার শ্বশুরের চিকিৎসার ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
প্রতিবেশী আমিনুল ইসলাম বলেন, বাবু চাচা অসহায় মানুষ। তার পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা। ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পর তার উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা পাড়া-প্রতিবেশী সামর্থ্য অনুযায়ী সহযোগিতা করেছি। সরকারি কিছু অনুদান পেলে চাচার পা থেকে অপারেশনের মাধ্যমে গুলিগুলো বের করা যেত। তাহলে তিনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতেন।
আহত বাবু মিয়ার চিকিৎসায় সহযোগিতার জন্য তার বড় ছেলে আশরাফুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের নম্বর-০১৭৬১১৫৮৩৮৪ (নগদ)।
এ ব্যাপারে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. আ.ম আখতারুজ্জামান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসায় বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় সবাই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। কোনো আহত ব্যক্তি হাসপাতালে ভর্তি হলে তাকে সাধ্য অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হবে।
ফরহাদুজ্জামান ফারুক/আরএআর