বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শুরু থেকেই সক্রিয় ছিল মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়ী উপজেলার আরএন উচ্চ বিদ্যালয় দশম শ্রেণির ছাত্র সাইফুল ইসলাম। সে টঙ্গিবাড়ী উপজেলার বেসনাল গ্রামের খোকন মাদবরের ছেলে।  

জানা যায়, আন্দোলনের শুরু থেকেই মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনে অংশ নেন সাইফুল। তার ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা-হামলার হুমকি দিয়েও তাকে দমানো যায়নি। পরিবারের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গত ৪ আগস্ট মুন্সীগঞ্জ সদরের সুপার মার্কেট এলাকায় আন্দোলনে অংশ নেয় সে। সকাল ১০টায় আন্দোলনের যোগদানের পরেই তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। সে সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রায় অর্ধশত শিক্ষার্থী আহত ও তিনজন নিহত হন। চোখের সামনে সহযোদ্ধাদের মরতে দেখেও দমে যায়নি সাইফুল।

ঘটনার দিন সম্মুখভাগে থেকে বিভিন্ন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার শিকার হচ্ছিল সে। দুপুরে না খেয়েও আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে সাইফুলসহ তার বন্ধুরা। একপর্যায়ে বিকেল ৩টার দিকে তাদের কাছে থাকা পানি ফুরিয়ে গেলে সাইফুল মুন্সীগঞ্জ কৃষি ব্যাংক এলাকায় বন্ধুদের জন্য খাবার পানি আনতে যায়। সেখানে যাওয়ার পরেই হামলার শিকার হয় সেসহ তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন। সাইফুল সে সময় ওই স্থান থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে এক পুলিশ তাকে ধরে ফেলে এবং ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে তুলে দেয়। সে সময় ছাত্রলীগকর্মীরা তাকে বেধড়ক পিটিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দেয়। তার হাত-পায়ে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে সাইফুল। তখন তাকে মৃত ভেবে ফেলে চলে যায় ছাত্রলীগের কর্মীরা। এক পুলিশ সদস্য তার মাথায় পানি ঢাললে জ্ঞান ফিরে আসে সাইফুলের। 

পরে ঘটনাস্থলের পাশের বাসার কয়েকজন নারী তাকে উদ্ধার করে তাদের বাড়িতে নিয়ে যায়। নিয়ে জিজ্ঞেসা করে তার এখানে কোনো আত্মীয় আছে কিনা। পরে সে তার মামা বাড়ির ঠিকানা দিলে ওই নারী তাকে একটি রিকশা ঠিক করে দেয়। রক্তাক্ত অবস্থায় রিকশায় চড়ে সাইফুল মুন্সীগঞ্জ আনসার ক্যাম্পের সামনে মামা বাড়িতে চলে আসে। সাইফুলের মামা রহমতউল্লাহ তখন খোঁজ জানতে পারে মুন্সীগঞ্জ সদর হাসপাতাল ঘেরাও করে রেখেছে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। সেখানে গেলে আবার হামলার শিকার হতে পারে। সেজন্য বাড়িতে ডাক্তার ডেকে এনে সাইফুলের কাঁটা স্থানে সেলাই করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরে তার মা-বাবাকে খবর দিয়ে তাকে নিজ বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নিজ বাড়িতে অসুস্থ ছেলেকে হাতে পেয়েও তার বাবা-মা পড়েন আরেক বিড়ম্বনায়। একদিকে অসুস্থ ছেলে আরেক দিকে পুলিশের হামলার ভয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটতে থাকে তাদের।

সাইফুল বলেন, যখন থেকে আমার ছাত্র ভাইয়েরা মার খেতে থাকে তখন থেকেই আমি আর ঘরে বসে থাকতে পারিনি। আমার এলাকায় আমি আমার বড় ভাইদের নিয়ে আন্দোলন করতে শুরু করি। এলাকায় বেশনাল চৌরাস্তায় আন্দোলন করলে স্থানীয় চেয়ারম্যান খুকুসহ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর হামলার চালানোর হুমকি দেয়। তারা শুধু আমাদেরই হুমকি দেয়নি আমাদের অভিভাবকদেরও প্রতিনিয়ত হুমকি দিতো। পরে আমি আগস্ট মাসের ৪ তারিখে আমার কয়েকজন বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমরা মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যাই। মুন্সীগঞ্জ সুইমিং পুলের কাছে যাওয়ার পরে পুলিশ আমাদেরকে শহরে ঢুকতে না দিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়। পরে আমরা সেখান থেকে হেঁটে গ্রামের ভেতর দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় যাই। সেখানে পুলিশ গুলি চালালে আমার চোখের সামনে আন্দোলন যোদ্ধা দুই ভাই মারা যায়। একপর্যায়ে খাবারের পানি আনতে মুন্সীগঞ্জ কৃষি ব্যাংক এলাকায় যাই। আমার সঙ্গে আরও ৫-৬ জন ছিল। সে জায়গায় ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের ওপর হামলা করে। আমি দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করি। এ সময় এক পুলিশ আমাকে ধরে ছাত্রলীগ কর্মীদের হাতে তুলে দিলে আমাকে মারধর করে মাথার একাধিক স্থানে ফাটিয়ে দেয়। সাপের মত আমাকে মারতে থাকলে আমি জ্ঞান হারায়ে ফেলি। পরে পুলিশ ও এক নারীর সহায়তায় মামার বাড়িতে আসি। আমার মামা বাড়িতে একটি ডাক্তার ও দুটি নার্স এনে আমার মাথাসহ বিভিন্ন স্থানে সেলাই করে দেয়। পরে আমার মা গিয়ে আমাকে বাসায় নিয়ে আসে।

এ ব্যাপারে মুন্সীগঞ্জের হরগঙ্গা কলেজের ছাত্র এ বছরের এইচএসসি পরিক্ষার্থী হিমেল বলেন, আমরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু হতেই কলেজসহ আমাদের এলাকায় আন্দোলন গড়ে তুলি। আমাদের এলাকার প্রতিটি আন্দোলনে সাইফুল আমাদের সঙ্গে ছিল। আওয়ামী লীগ ও পুলিশ বিভিন্নভাবে আমাদেরকে হামলার হুমকি দিচ্ছিল, আমাদের গার্জিয়ানদেরকেও হুমকি দিচ্ছিল। তারা আমাদের এলাকায় আমাদের আন্দোলন করতে দিচ্ছিল না। উপজেলা ও স্থানীয় চেয়ারম্যানসহ আওয়ামী লীগ নেতারা আমাদেরকে আন্দোলন তো দূরের কথা বেশনাল চৌরাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়নি। পরে ৪ আগস্ট আমি সাইফুলসহ ১৫ হতে ২০ জন মুন্সীগঞ্জ সুপার মার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেই। পৌঁছানোর পরই আমাদের ওপর হামলা হয়। পাখির মত নির্বিচারে আমাদের উপর গুলি ছোঁড়া হয়।

দিঘীরপাড় উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মাহিম বলেন, ৪ তারিখ সকাল বেলা ১৫ জন এক সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দেই। আমরা মুন্সীগঞ্জে পৌঁছাতে ১০টা বাজে যখন আমরা জড়ো হই তখন ছাত্রলীগ গুলি করলে আমরা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমি আর সাইফুল কৃষি ব্যাংকের সামনে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওখানে গিয়ে আশ্রয় নেই। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার একপর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।

এ ব্যাপারে সাইফুলে বাবা খোকন মাদবর বলেন, ছাত্র আন্দোলন শুরুর পর হতেই আমার ছেলে আমাদের না জানিয়ে বিভিন্ন আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এলাকার আওয়ামী লীগ নেতারা এবং পুলিশ আমাকে জানালে আমি বারবার ওকে বারণ করি । ৪ তারিখে আমি সকালে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গেলে সাইফুল আমাকে না জানিয়ে আন্দোলনে মুন্সীগঞ্জ চলে যায়। আমি বাড়িতে আসার পর ওর মা বলে সাইফুল আন্দোলনে গেছে। আর বলে গেছে, আমার ছাত্র ভাইরা যেভাবে মাইর খাইতেছে এই অবস্থায় ঘরে বসে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব না। মরে গেলে মাফ করে দিও বলে বাড়ি হতে বের হয়ে গেছে। 

এ কথা শুনে আমি বার বার ওর মোবাইলে ফোন দিচ্ছিলাম । ও কিছুতেই ফোন রিসিভ করছিল না। ওই দিন বিকেল ৫টার দিকে ওর মামা ফোন করে জানালে আমি ওর মা ও নানাকে পাঠাইয়া দেই। ছেলে আসলে দেখি শরীরে এমন কোন স্থান নাই যেখানে আঘাত করা হয়নি। ওর আহত হওয়ার খবর পেয়ে গ্রামের মানুষজন আমাদের বাড়িতে ছুটি আসে। মানুষজন বলতে থাকে ওকে লুকিয়ে রেখ নাহলে পুলিশ তোমাদের বাসায় হামলা করবে। আমি ভয়ে চিকিৎসা করাব না ওরে লুকিয়ে রাখব এ নিয়ে কাতর হয়ে পড়ি। পরে দেশের অবস্থা ভালো হলে ওরে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। পাঁচ দিন ও হাসপাতালে ভর্তি ছিল। এখনো ও অনেক অসুস্থ, হাত ঠিকমতো নাড়তে পারে না। ঠিকমতো হাঁটাচলা করতে পারে না। রাতে আমি ওর সাথে ঘুমাই। প্রায়ই রাতেই ও ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাকে আর মাইরেন না।

ব.ম শামীম/আরকে