‘হাঁচচল্লিশ (৪৫) দিন ধরি আমরা হানিততে (পানিতে) ভাইসতেছি (ভাসছি)। ঘরে ক’দিন (কয়েকদিন) ভাতটাতও রান্না অয় ন (হয়নি)। ক’দিন ভাত খাইতে হারি ন। মাইনষের দেওয়া ত্রাণের হুকনা (শুকনো) খানাই আমগো ভরসা আছিল। হানি অল্প অল্প কমে। মানুষ আর কতদিন থাইকবো এই হানির মইদ্যে? আমরা এই হানির তুন মুক্তি চাই।’

আক্ষেপের সুরে কথাগুলো বলছিল লক্ষ্মীপুরের ১৪-১৫ বছর বয়সী কিশোর কামরুল ইসলাম।

প্রায় দেড় মাস ধরে পানিবন্দি হয়ে আছেন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলার ৩ লক্ষাধিক মানুষ। ধীর গতিতে পানি কমলেও বিন্দুমাত্র দুঃখ কমছে না তাদের। এ দুই উপজেলা দিয়ে বয়ে চলা ভুলুয়া নদীতে অবৈধ দখলদারদের শত শত বাঁধ এখানকার বাসিন্দাদের দুর্দশার প্রধান কারণ বলে অভিযোগ তাদের।

সরেজমিনে বন্যা কবলিত কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের বাদামতলি ও চরবসু, রামগতির চরবাদাম ও চরপোড়াগাছা এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, চারদিকে পানি থই থই করছে। তবে এ পানি দুই-একদিন কিংবা এক সপ্তাহের জমা না। প্রায় দেড় মাস আগে থেকে সেখানে পানি জমে আছে। ধীর গতিতে কমলেও স্বস্তি ফিরছে না মানুষের মাঝে। এখনো এসব এলাকার মানুষের ঘরের ভেতর থেকে পানি সরেনি। গোয়াল ঘরে হাঁটু পরিমাণ পানি। ভাসছে হাঁস-মুরগির খোয়াড়ও। এমন পরিস্থিতিতে বাড়ির সামনে ও দূরের রাস্তাগুলোতে মিলেছে গৃহপালিত গরু-ছাগলের আশ্রয়।

আবার অনেকেই সঙ্গে করে আশ্রয়ণকেন্দ্রে নিয়ে গেছেন গবাদিপশু। যারা বাড়িতে আছেন, তাদের অধিকাংশ বাসিন্দাই খাট অথবা চৌকির এক কোণে ঝুড়িতে করে হাঁস-মুরগির নিরাপদে রেখেছেন বলে জানা গেছে। অনেকে ভুলে গেছেন শেষ কবে ঘরে মাটির চুলায় রান্না করেছেন। সরকারি-বেসরকারিভাবে দেওয়া শুকনো খাবার ছাড়া অনেকেই রান্না করা খাবার খেতে পারেননি বন্যার শুরু থেকেই। এছাড়া মানুষজন ডায়রিয়া ও চর্মরোগসহ পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে দূর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রামগতি ও কমলনগর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে ভুলুয়া নদী এলাকায় টানা ২০ দিন বৃষ্টি হয়েছে। এ বৃষ্টির পানি জমে মৃতপ্রায় ভুলুয়াও এখন থইথই করছে। বেঁড়িবাঁধের বাইরে লোকালয়ে প্রায় ৫ ফুট উচ্চতা ধারণ করেছে পানি। বৃষ্টি থামলেও কমছিল না পানিবৃদ্ধি।

এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ প্রভাবশালীদের দেওয়া অবৈধ বাঁধের কারণে প্রবাহ নেই ভুলুয়াতে। এতে ভুলুয়া নদীর পানি কোনো দিকে সরছেও না। এমন অবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে মৃত্যুকূপে পরিণত হয়েছে ভুলুয়া। এরপর এক সপ্তাহ আগে নোয়াখালীর বন্যার পানি চাপ দিয়েছে আগ থেকেই বিপর্যয়ে থাকা রামগতি-কমলনগরের বিস্তীর্ণ এলাকায়। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা দলবদ্ধ হয়ে ভুলুয়া নদীর বিভিন্ন স্থানে থাকা অবৈধ বাঁধ অপসারণের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রভাবশালীদের সঙ্গে টিকে উঠতে পারছে না বিপর্যস্ত মানুষগুলো।

প্রশাসনের জোরালো হস্তক্ষেপই পারে ভুলুয়াকে দখলমুক্ত করে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষকে বাঁচতে সহায়তা করতে। এমনটাই দাবি জানিয়েছেন পানিবন্দিরা।

বাদামতলি এলাকার বৃদ্ধ ঈমান আলী জানান, ৭০ সালের বন্যাতেও এতোদিন ধরে পানি জমা ছিল না। এতো পানিও ছিল না। ঘরে ১০ জন সদস্য। কাজকর্ম বন্ধ হয়ে খুব বিপর্যয়ে আছি। মানুষ যা ত্রাণ দিচ্ছে সেটিই এখন একমাত্র ভরসা। আগামী দুই মাসেও স্বাভাবিকভাবে জীবন-যাপন করতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না।

বন্যায় দুর্গত যুবক মঞ্জুর আলম জানান, কোমর পানিতে চলাফেরা করতে গিয়ে পুরো শরীর চুলকাচ্ছে। খোস পাঁচড়া উঠে খুব কষ্টে আছি।

চরবসু এলাকার বাসিন্দা আমির হোসেন বলেন, ত্রাণ না দিয়ে পানি কমার ব্যবস্থা করেন। পানি আমাদের সব শেষ করে দিয়েছে। খামার, ফসলি ক্ষেত সব ডুবে আছে। কবে পানি কমবে, কবে আমরা স্বাভাবিক জীবনে যেতে পারবো। প্রভাবশালীরা ভুলুয়া নদীতে বাঁধ দেওয়ার কারণেই আমাদের এ দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস ছুটিতে থাকায় ভুলুয়া নদী থেকে অবৈধ বাঁধ অপসারণ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তার পদে অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) শামছুদ্দিন মো. রেজা বলেন, কমলনগরে এখনো ১ লাখ ৮৮ হাজার মানুষ পানিবন্দি আছেন। ১৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে ৩ হাজার মানুষ রয়েছেন। বন্যার পানি কমানোর জন্য আমরা অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযান চালিয়েছি। পানি প্রবাহ রোধকারী বেয়াল জালগুলো অপসারণ করেছি। অবৈধ বাঁধগুলো অপসারণে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। ইউএনও ফিরলে এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আলোচনা করা হবে।

পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা জানাতে না পারলেও রামগতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ আমজাদ হোসেন বলেন, আমাদের ১৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে আছে। ৪ হাজারের বেশি মানুষ সেগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। পানি কমতে শুরু করায় অনেকে বাড়ি চলে গেছেন। এখন প্রায় ২ হাজার ৮০০ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, রামগতি ও কমলনগরে প্রায় ৩ ফুট পানি কমেছে। পানিতে ডুবে থাকা গ্রামীণ অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলোও জেগে উঠেছে। অধিকাংশ মানুষের ঘর থেকে পানি নেমে গেছে। তবে বাড়ির উঠান-ক্ষেতসহ বিস্তীর্ণ এলাকা এখনো পানির নিচে।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এফআরএস