চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে বালু বিক্রির দেড় কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
নরসিংদীর রায়পুরায় মরজাল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের বিরুদ্ধে বালু বিক্রির দেড় কোটিরও বেশি টাকা আত্মসাতের ঘটনার ছয় মাস পেরোলেও এখন পর্যন্ত অভিযোগকারীদের সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন। এতে প্রশাসনের বিরুদ্ধেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এদিকে এ ছয় মাসে পর পর দুইবার বদলি হয়েছে এ উপজেলায় কর্মরত দুই নির্বাহী কর্মকর্তা।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে একের পর এক সংবাদ প্রকাশের পরও আত্মসাতকৃত টাকার বিষয়ে সাংবাদিকদের সুস্পষ্ট কোনো তথ্যও দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সূত্র ও অভিযোগকারীরা জানিয়েছেন, উপজেলার মরজাল ইউনিয়নের ধুকুন্দি চরে পার্শ্ববর্তী আড়িয়াল খাঁ নদী থেকে ২০১৯-২০ সালে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করা হয়। পরে ওই বালু এলাকার স্থানীয় কৃষকদের জমিতে রাখা হয়। এমতাবস্তায় ২০২১ সালে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আতাউর রহমান মরজালের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হলে, সেই বালুতে তার নজর পরে। প্রায় ২০ কানি জমির উপর রাখা কয়েক লাখ ফুট বালু চেয়ারম্যান আতাউর রহমান ও তার সহযোগী সারোয়ার হোসেন শাহিনের যোগসাজশে ২০২৩-২৪ সালের ডিসেম্বর-জানুয়ারির মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকায় ফেয়ার ইলেকট্রনিক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেন। পরে স্থানীয় জমির মালিক সাঈদ মিয়া, হারিছুল হক, সাইফুল ইসলামসহ আরও অন্যান্য কৃষকের পক্ষে শহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর দাখিল করা হয়। তবে অদৃশ্য ক্ষমতাবলে স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে দেন চেয়ারম্যান আতাউর রহমান।
অন্যদিকে প্রশাসনের কাছে দেওয়া অভিযোগপত্র ও সাংবাদিকদের দেওয়া ভুক্তভোগীদের স্বাক্ষাৎকার অনুযায়ী এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। পরে সাংবাদিকদের তোপের মুখে পড়ে নরসিংদী জেলা প্রশাসকের নির্দেশে রায়পুরা উপজেলা সহকারী কমিশনার ভূমি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তা ও সার্ভেয়ারকে নিয়ে একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সেখানে থাকা বালু মাপে। পরে সে রিপোর্ট জেলা প্রশাসক বরাবর প্রদান করা হয়। তবে এ বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযোগকারীদের বিস্তারিত জানানো হয়নি বলেও দাবি করেন অভিযোগকারীরা।
স্থানীয় জমির মালিকরা জানান, সেনাবাহিনী কর্তৃক স্থানীয় কৃষকদের জমির পাশে নদী খননের সময় অতিরিক্ত বালু কৃষকদের জমিতে ফেলা হয়। এ সময় ২৭/২৮ জন কৃষকের প্রায় ২০ কানি জমির উপর এ বালু ফেলা হয়। এমতাবস্থায় ফেয়ার ইলেকট্রনিকস নামে একটি প্রাইভেট কোম্পানি সেখানে স্থানীয়দের কাছ থেকে কিছু জমি ক্রয় করে। তবে নদী থেকে সেনাবাহিনী কর্তৃক বালু উত্তোলন করে আমাদের জমিতে রাখা সেই বালু বিক্রিবাবদ দেড় কোটি টাকা হাতিয়ে নেন চেয়ারম্যান। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে চেয়ারম্যান আতাউর ও সহযোগী শাহিন লোকলজ্জার ভয়ে সাত-আটজন জমির মালিককে কিছু কিছু টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। জমির অন্য মালিকরা তার কাছে বালু বিক্রির টাকা চাইতে গেলে চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের দলীয় প্রভাব খাঁটিয়ে নানা ভয়ভীতি দেখান। এ ব্যাপারে কৃষকরা উপজেলা চেয়ারম্যানসহ স্থানীয় লোকজনকে মৌখিকভাবে জানালে ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান কৃষকদের উপর আরও বেশি ক্ষিপ্ত হন। পরে গত ৬ ফেব্রুয়ারি কৃষকদের পক্ষে স্থানীয় শহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত একটি অভিযোগপত্র উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট দাখিল করেন। তবে এ অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযোগকারীকে এখনো পর্যন্ত কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখা দিতে পারেনি উপজেলা প্রশাসন।
শহিদুলের চাচা ও জমির মালিক সাঈদ মিয়া জানান, জমি বিক্রির টাকার বিষয়ে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে আমরা অভিযোগ করি। অভিযোগের কিছুদিন পর চার-পাঁচজনের একটি দল নিয়ে এসিল্যান্ড স্যার এখানে এসে জমির বালু মেপে ডিসি স্যারকে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। এইটুকুই আমরা জেনেছি। আর কোনো কিছুই আমাদের জানানো হয়নি। তবে আতাউর আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান ও রায়পুরার সাবেক এমপি রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজুর লোক হওয়ায় সেই সময়ের ইউএনও স্যার রোজলিন শহীদ চৌধুরী আমাকে উপজেলা পরিষদে ডাকেন। সেখানে নিয়ে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, তার ওপর এমপি স্যারের হাত আছে, তিনি বিষয়টিতে কিছু করতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। তবে এর আগের ইউএনও স্যার আজগর হোসেন আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছিলেন, যদি তিনি টাকা উদ্ধার না করে দিতে পারেন, তাহলে তিনি থানায় মামলার ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতা করবেন। তার কিছুদিন পর ওনি বদলি হয়ে যান। তবে অতিদ্রুত বিষয়টি নিয়ে আমরা আবারও ইউএনও স্যার এবং সাংবাদিকদের মুখোমুখি হবো।
তবে এ ব্যাপারে অভিযুক্ত মরজাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি সকল কৃষককে তাদের টাকা পরিশোধ করে দিয়েছি। কয়েক দফায় আমি তাদের টাকাগুলো পরিশোধ করেছি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, আমাকে বিষয়টি কয়েকজন সাংবাদিক জানিয়েছিলেন। তখন কাজটা সেনাবাহিনী করেছিল তো, এখন কারা করছে, কীভাবে করছে—এ বিষয়ে আমরা জানি না। সে ক্ষেত্রে বিষয়টা একটু সময় সাপেক্ষ। আমি এখনো জানি না, বিষয়টা কোন অবস্থায় আছে।
জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ড. বদিউল আলম বলেন, এমন একটি অভিযোগ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে আমরা উপজেলা প্রশাসনকে বিষয়টি তদন্তের নির্দেশ দিই। পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ওনারা বালু বিক্রি করতে পারেনি। তারা ওই সময় কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল, কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেনি। আমরা সেটি বন্ধ করেছি। সবশেষ খবর কী তা খোঁজ নিলে জানতে পারব।
তন্ময় সাহা/এএমকে