লক্ষ্মীপুরে বন্যার পানিতে এখনো দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে ১০ লক্ষাধিক মানুষ। তাদের খাদ্য সংকট দূর করতে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা হাজারো তরুণ-যুবক ও শিক্ষার্থী লক্ষ্মীপুরের দুর্গম এলাকাগুলো চষে বেড়াচ্ছেন। খাদ্যসামগ্রী নিয়ে মাইলের পর মাইল হেঁটে, নৌকা ভাসিয়ে তারা অসাধ্যকে সাধন করছেন। গলা পানিও তাদের আটকাতে পারেনি। অদম্য এই সেচ্ছাসেবীরা দুর্গম এলাকার পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুঃখ-দুর্দশার সাক্ষী হয়ে রয়েছেন। তাদের মুখে বানভাসিদের দুরবস্থার গল্প শুনে চোখে পানি চলে আসার অবস্থা সৃষ্টি হয়।

সম্প্রতি লক্ষ্মীপুর জেলায় বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণ দিতে আসা নাটোর, বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জেলার স্বেচ্ছাসেবী, শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের উদ্যোক্তাদের কথায় বানভাসি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র ফুটে উঠে। ঢাকা পোস্টের কথা হলে চট্টগ্রামের জোবায়ের হোসেন মুন্না, আব্দুল কাদের, মো. শাওন, রাজশাহীর ইউছুফ হাসান, নাটোরের মনিরুল ইসলাম, লক্ষ্মীপুরের সাইফুল ইসলাম ও তৌকির আহমেদ তাদের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন।

বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) সন্ধ্যায় লক্ষ্মীপুরের যাদৈয়া গ্রামে কোমর পানিতে হেঁটে হেঁটে রান্না করা খাবারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিতরণ করছিলেন চট্টগ্রাম ওমর গণি এম এস কলেজের একঝাঁক শিক্ষার্থী। বন্যায় দুর্গতদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তাদের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের ঢাকা পোস্টকে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাই খাবার বেশি চাচ্ছে। জামা-কাপড় এরকম কিছুই চাচ্ছে না। খাবারটা হলেই ভালো হয়। তবে শুকনা খাবার নয়। শুকনো খাবার মানুষ আর কত খাবে? রান্না করা খাবার। যেমন খিচুড়ি দেওয়া যেতে পারে। চিড়া-মুড়ি মানুষ এখন খেতে পারছে না।

চট্টগ্রাম থেকে আসা যুবক জোবায়ের হোসেন মুন্না বলেন, ফেনী থেকে আমরা লক্ষ্মীপুরে এসেছি। এখানে মানুষের বাড়িঘর ডুবে গেছে। পানি তেমন কমছে না। বিপদে পড়া এখানকার বাসিন্দাদের দিকে আমাদের সবাইকে তাকাতে হবে। তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে হবে। এখানকার মানুষ অনেক কষ্ট পাচ্ছে। কয়েক দিন ধরে অনেকের বাড়িতে রান্নাও হচ্ছে না। সিলিন্ডারের গ্যাস শেষ হয়ে গেলে নতুন করে আনার সুযোগটাও পাচ্ছেন না তারা। মানুষ খেতে পারছে না। যে যতটুকু পারেন তাদের জন্য খাবার নিয়ে আসবেন।

লক্ষ্মীপুরের সন্তান সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেই দুপুরে বের হয়েছি। প্রথমে দিঘলী ইউনিয়নের বেঁড়ি এলাকায় যাই। জায়গাটি দুর্গম ছিল। বেঁড়ির পরে ভেতরের গ্রামের অনেকগুলো মানুষ আছে। যেখানে ৪-৫ ফুট পানি। পরে আমরা দুইটি বোট নিয়ে সেখানে যাই। সেখানে মানুষ খাবারের জন্য হাহাকার করছিল। খুব বাজে অবস্থায় আছে মানুষ। সেদিকে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র নেই। স্কুলও নেই। মানুষ যে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে থাকবে সেরকম সুযোগও নেই। সেখানকার মানুষগুলো ঘর ছাড়ছে না। ঘরের মায়া ছাড়ছে না তারা। অনেক বুঝাইছি, কিন্তু লাভ হয়নি। দুর্গত এলাকায় বিদ্যুৎ সঞ্চালন রয়েছে। যা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা কাজ করছি, এটি আমাদের জন্যও ঝুঁকি।

চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী মো. শাওন বলেন, ফেনী লালপোল, মুহুরি প্রজেক্ট এলাকায় ত্রাণ বিতরণ শেষে লক্ষ্মীপুরে এসেছি। প্রায় ৩-৪ হাজার মানুষের মাঝে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি। সরাসরি দুর্গতদের হাতেই তুলে দিয়েছি আমাদের উপহার।

বন্যায় দুর্গতদের ত্রাণ বিতরণ করছেন আহলে হাদিস বাংলাদেশ। রাজশাহী থেকে তাদের টিম লক্ষ্মীপুরে আসে। এতে সমন্বয়কের দায়িত্বে রয়েছেন লক্ষ্মীপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ইলেকট্রনিক্স বিভাগের শিক্ষক ইউছুফ হাসান। বৃহস্পতিবার বিকেলে যাদৈয়া এলাকায় বন্যায় দুর্গত একটি নারীর করুণ চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, বন্যাকবলিত এলাকায় আমাদের ৯টি টিম ত্রাণ বিতরণে কাজ করছে। বুধবার ত্রাণ বিতরণ করেছি। লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার অলিপুর গ্রামের একদম দুর্গম এলাকায়। যেখানে এর আগে ত্রাণ পৌঁছায়নি। সেখানে একজন নারী তার খাটটি ঘরের আড়ার সঙ্গে বেঁধে রেখেছেন। সেখানেই তিনি বসবাস করছেন। ঘরের মায়া ছাড়তে পারেননি। এজন্য তারা ঘর ছেড়ে যাননি। তিনি জানিয়েছেন, তার একমাত্র ছেলে প্রবাসে থাকে। এজন্য এ পানিতে বাজারে গিয়ে বাজার করার মতো কেউ নেই। কেউ তার খোঁজ নিতেও যাননি। কোনো ত্রাণও তিনি পাননি।

লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় রওশন জাহান ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ শিক্ষার্থীরা ত্রাণ বিতরণ করেছেন। বুধবার বিকেলে সদরের দিঘলী ইউনিয়নের পশ্চিম জামিরতলি এলাকায় কথা হয় তাদের সমন্বয়ক তৌকির আহমেদের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পরিবারের কাছে আমাদের শিক্ষার্থী ভাইয়েরা খাদ্য সহায়তা পৌঁছে দিয়েছে। বুকসমান পানি অতিক্রম করে দুর্গতদের কাছে আমাদের টিমের সদস্যরা খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছে। দুর্গম এলাকায় যারা পায়নি, তাদের মাঝে আমরা এ উপহার পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

বুধবার বিকেলেই সদরের জামিরতলি বাজারে কথা হয় নাটোরের গ্লোবাল ড্রিম এলাইভ ফাউন্ডেশনের সেক্রেটারি মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রায় ১৫০০ প্যাকেট শুকনো খাবার নিয়ে আমরা লক্ষ্মীপুরে এসেছি। আমরা ত্রাণ দিতে আসিনি। আমরা সহযোগিতা করতে এসেছি। এখনকার স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বয় করে খাদ্য সামগ্রীগুলো বিভিন্ন গ্রামের দুর্গতদের কাছে পৌঁছে দিয়েছি। লক্ষ্মীপুরের ৪-৫টি এলাকায় আমরা খাবারগুলো বিতরণ করেছি। স্থানীয় লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করেছেন।

প্রসঙ্গত, ২৩ আগস্ট থেকে নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী খাল, ওয়াপদা খাল ও ভুলুয়া খাল দিয়ে লক্ষ্মীপুর জেলায় ঢুকে পড়ে। এতে সদর উপজেলাসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা দেখা দেয়। উজান থেকে অনবরত লক্ষ্মীপুরে পানি ঢুকছে। টানা তিন দিন লক্ষ্মীপুরের আকাশে সূর্যের ঝলকানি থাকলেও ধীরগতিতে কমছে বানের পানি।

হাসান মাহমুদ শাকিল/এমজেইউ