গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে আত্মগোপনে আছেন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের (কুসিক) সাবেক মেয়রসহ ডজনখানেক কাউন্সিলর। গা ঢাকা দেওয়া এ সকল কাউন্সিলর অপসারিত মেয়র তাহসীন বাহার সূচনা ও সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহারের আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন বলে জানা গেছে। বাহার-সূচনার করুণাতেই কাউন্সিলর হয়েছিলেন তারা। 

এসব কাউন্সিলরের মধ্যে কেউ কেউ সরকার পতনের সঙ্গে সঙ্গে গা ঢাকা দিলেও অনেকেই ধীরে ধীরে আত্মগোপন করেন। সিটির ২৭টি ওয়ার্ডের ডজনখানেক কাউন্সিলর গা ঢাকা দেওয়ায় স্থবির হয়ে পড়েছে সেসব ওয়ার্ডের নাগরিক সেবা। এসব কাউন্সিলরদের কেউ কেউ অফিসে না এলেও গোপন স্থান থেকে অফিসের কাজ করছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে  জানা গেছে। তবে সংখ্যাটি খুবই কম।

এদিকে মেয়র সূচনার অপসারণের পর কুমিল্লা সিটিতে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান সাইফ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড) কুমিল্লার মহাপরিচালক। গত ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে কুসিকের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। গত ২৮ আগস্ট (বুধবার) নতুন প্রশাসকের সভাপতিত্বে সিটি কর্পোরেশনের মাসিক মিটিং অনুষ্ঠিত হয়। ওই মিটিংয়ে সিটি কর্পোরেশনের ২৭ জন সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ৯ জন সংরক্ষিত নারীসহ ৩৬ কাউন্সিলরের মধ্যে ১২ জন পুরুষ কাউন্সিলর অনুপস্থিত থাকেন। সকল নারী কাউন্সিলরসহ মোট ২৪ জন কাউন্সিলর উপস্থিত থাকেন ওই মিটিংয়ে।  

কাউন্সিলরদের মধ্যে ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী গোলাম সারওয়ার শিপন, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরকার মাহমুদ জাবেদ, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ রায়হান আহমেদ, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আমিনুল ইকরাম, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জমির উদ্দিন খান জম্পি, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মনজুর কাদের মনি, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের হাবীবুর আল আমিন সাদী, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল কালাম আজাদ, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের হানিফ মাহমুদ, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের শওকত আকবর, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আজাদ হোসেন ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আব্দুস সাত্তার এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসান উপস্থিত ছিলেন না। 

ওই মিটিংয়ে আত্মগোপনে থাকা সেসব কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডে নাগরিক সেবাকে বেগবান করতে পাশের ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয় ভোগান্তির বিষয়টি মাথায় রেখে। পাশাপাশি সেসব ওয়ার্ডে উন্নয়ন কাজ তদারকি করার জন্য ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদারকি কমিটিও গঠন করা হয়। সিটি কর্পোরেশনের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র ঢাকা পোস্টকে এসব তথ্য জানিয়েছেন। 

অপরদিকে আত্মগোপনে থাকা সেসব কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে হত্যাসহ এখন পর্যন্ত মোট ৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগের প্রধান আসামি কুমিল্লা সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহার এবং দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে অপসারিত সাবেক মেয়র তাহসীন বাহার সূচনাকে। এসব মামলার মধ্যে ১টি হত্যাসহ, অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, মিছিলে হামলা ও গুলির অভিযোগ আনা হয়েছে। 

গত ৪ আগস্ট ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কোটবাড়ি নন্দনপুর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিক্ষোভ মিছিলে হামলা চালিয়ে গুলি করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাসুম মিয়া নামের এক হোটেল কর্মচারী নিহত হন। এ ঘটনায় গত ১৯ আগস্ট কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় সাবেক সংসদ সদস্য বাহারকে প্রধান আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। হত্যার এই মামলায় বাহার-সূচনা ছাড়াও, মহানগর ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ৬২ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ করে ৪০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলায় সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান ৬ কাউন্সিলরের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। 

তারা হলেন- প্যানেল মেয়র ও ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবীবুর আল আমিন সাদী, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরকার মাহমুদ জাবেদ, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আজাদ হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আনোয়ার হোসেন, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আমিনুল ইকরাম এবং ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আবুল হাসান। 

হত্যা মামলার আগে থেকেই এই ৬ কাউন্সিলরসহ বাহার-সূচনার মদদপুষ্ট ডজনখানেক কাউন্সিলর আগেই এলাকা ছাড়েন। তবে হত্যা মামলা থেকে বাদ পড়লেও বাহারের অনুসারী সকল কাউন্সিলর বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন। 

সিটি কর্পোরেশনের পুরুষ ২৭ কাউন্সিলরের মধ্যে ২ জন বিএনপির এবং ২ জন জামায়াতের নেতা। ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর গোলাম কিবরিয়া ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. একরাম হোসেন জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এছাড়া ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজিউর রহমান রাজিব এবং ২১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর কাজী মাহবুবুর রহমান বিএনপির রাজনীতি করেন। তারা চারজন বাদে বাকি ২৩ কাউন্সিলরই আওয়ামী লীগের এবং সাবেক সংসদ সদস্য বাহাউদ্দীন বাহারের অনুসারী। 

২৩ জনের মধ্যে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন ১৫ জন কাউন্সিলর। তারা সবাই বাহার-সূচনাপন্থী। 

মামলায় আসামি হওয়া কাউন্সিলররা হলেন- ১১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর আল আমিন সাদী, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের জমির উদ্দিন খান জম্পি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সরকার মাহমুদ জাবেদ, ২২ নম্বর ওয়ার্ডের আজাদ হোসেন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আনোয়ার হোসেন, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের আবুল হাসান, ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাজী গোলাম সরওয়ার শিপন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের মনজুর কাদের মনি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সৈয়দ রায়হান আহমেদ , ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের আবদুস সাত্তার, সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডের  (১,২ ৩) কাউসারা বেগম সুমি, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের আমিনুল ইসলাম ইকরাম, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডের হানিফ মাহমুদ, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডের এমদাদ উল্যাহ ও ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শওকত আকবর।

অপরদিকে গা ঢাকা দেওয়া কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডগুলোতে পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মৌখিকভাবে দায়িত্ব দেওয়া হলেও লিখিত কোনো আদশ পাননি বলে জানিয়েছেন সিটির অন্য কাউন্সিলররা। 

নগরীর ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর রাজিউর রহমান রাজিব ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেদিন মিটিংয়ে আমাদের মৌখিকভাবে জানানো হয়েছিল এলাকায় অনুপস্থিত কাউন্সিলরদের ওয়ার্ডে নাগরিক সেবা দেবেন পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলররা। তবে আমাদের লিখিত কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। আমার পাশের ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর এলাকায় নেই। আমাকে ওই ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালনের লিখিতভাবে আদেশ দেওয়া হয়নি কিংবা অফিসিয়াল ফরমেট দেওয়া হয়নি। ফলে আমি চাইলেও সেই ওয়ার্ডে গিয়ে সেবা দিতে পারছি না।

আবার পলাতক কাউন্সিলরদের সেসব ওয়ার্ডে সেবা নিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছে সর্বস্তরের মানুষ। কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে স্থবির হয়ে পড়া উন্নয়নমূলক কাজ, ট্রেড লাইসেন্স, নাগরিক সনদ, জন্মনিবন্ধন ও মৃত্যুসনদসহ যাবতীয় নাগরিক সেবায় ভোগান্তির অন্ত নেই। 

৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মইনুল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমার দোকানের ট্রেড লাইসেন্স হালনাগাদ করতে চেষ্টা করছি। কাউন্সিলর সাহেব এলাকায় না থাকায় সেটা করতে পারছি না।

১১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আফসানা আকতার শারমিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাচ্চার জন্মনিবন্ধন করতে কয়েকদিন কাউন্সিলর অফিসে ঘুরে এসেছি। সচিব বলেছেন এখন কাউন্সিলর নেই তাই কার্যক্রম বন্ধ আছে। 

আত্মগোপনে থাকা কাউন্সিলরদের সবার মোবাইল ফোন বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। 

কুসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সামছুল আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, নাগরিক সেবায় ভোগান্তি নিরসনে অনুপস্থিত কাউন্সিলরদের পরিবর্তে বিধি মোতাবেক পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দায়িত্ব পালন করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশের ওয়ার্ডের কাউন্সিলরও যদি পলাতক থাকেন তবে সে বিষয় নিয়েও প্রশাসক মহোদয় সিদ্ধান্ত নেবেন কাকে দায়িত্ব দেবেন। আমরা সেটার রেজুলেশন তৈরি করছি। তাতে দুয়েকদিন সময় লাগতে পারে। 

আরএআর