বর্তমানে সবকিছুই ডিজিটাল নির্ভর হয়ে গেছে। অনেকটা হাতের মুঠোয় থাকা ফোনেই যেন বন্দী আস্ত পৃথিবী। শৈশব, কৈশোর থেকে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাস। কার্যত এই অবনতি রুখতেই কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে গড়ে তোলা হয়েছে বইয়ের প্রচ্ছদের আদলে ব্যতিক্রমী এক বই-দেয়াল বাড়ি। দৃষ্টিনন্দন এই বাড়ি দেখতে আসছেন উৎসুক দর্শনার্থীরাও।

জানা গেছে, কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর ইউনিয়নের কালে খাঁ ভাণ্ডা গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত শামছুল হক ভূঁইয়া ও তার স্ত্রী ছিলেন বই প্রেমিক। বাবা-মার মতো বই পড়ার অভ্যাস ছেলে রাকিব হাসানেরও। তাই তিনি নিজে বই পড়ার পাশাপাশি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করেন বই পড়তে। পাশাপাশি মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি-প্রেক্ষাপটসহ বাঙালি জীবন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এক অনুকরণীয় উদ্যোগ নিয়েছেন এই বই-দেয়াল করার।

শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সরেজমিনে ওই বই-দেয়াল করা বাড়িটিতে গিয়ে দেখা যায়, স্কুল শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন মানুষের উপস্থিতি।

এসময় কথা হয় বই-দেয়াল বাড়ির পাশেই স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা ইউসুফের সঙ্গে। তিনি জানান, বইয়ের মতো করে দেয়ালওয়ালা বাড়িটি সবার দৃষ্টি কেড়েছে। এখান থেকে অনেক কিছু জানার এবং শেখার আছে। এখানে অনেক ধর্মীয় বইয়ের নামও দেওয়া আছে।

কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেলপথের সন্নিকটে অবস্থিত আনন্দধারা নামে ছবির মতো এই বই-দেয়াল বাড়িটিও এখন আসা-যাওয়ার পথে ট্রেন যাত্রীদেরও দৃষ্টি কাড়ে।

সরজমিনে দেখা যায়, স্টিলের পাত দিয়ে তৈরি বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী সব বইয়ের নাম ও মোড়কে সাজানো হয়েছে বাড়ির সামনের দেয়াল। যেখানে কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’, জসীম উদ্দীনের ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, আনিসুল হকের ‘মা’, হিসাম আল আওয়াদির ‘বি স্মার্ট ইউথ মুহাম্মদ’, স্যার সৈয়দ আমির আলীর ‘দ্য স্পিরিট অব ইসলাম’, ইসলামী ফাউন্ডেশনের ‘সীরাতে ইবনে হিসাম’, সমরেশ মজুমদারের ‘গর্ভধারিণী’, সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’, হুমায়ূন আহমেদের ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘লালসালু’, আরিফ আজাদের ‘প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ’, খালেদ হোসেইনির ‘দ্য কাইট রানার’, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’, জীবনানন্দ দাসের ‘বনলতা সেন’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘ট্রাইটন একটি গ্রহের নাম’ ও ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, আলেক্সান্দর বেলায়েভের ‘উভচর মানুষ’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’, জাহানারা ইমামের ‘একাত্তরের দিনগুলি’, হারুকি মুরাকামির ‘নরওয়েজিয়ান উড’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য দীঘল বাড়ি’, আল্লামা ইবনে কাসিরের (রহ:) ‘তাফসিরে ইবনে কাসির’, জহির রায়হানের ‘বরফ গলা নদী’, আইজাক আসিমভের ‘ফাউন্ডেশন’, হুমায়ূন আহমেদের ‘তোমাদের জন্য রূপকথা’ ও হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ রশীদ হায়দারের ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ ইত্যাদি বই স্থান পেয়েছে রাকিব হাসানের বইয়ের দেওয়ালে।

তার এই নান্দনিক আয়োজন ইতোমধ্যেই গোটা এলাকায় সাড়া জাগিয়েছে।

স্কুলশিক্ষার্থী শাহিনা আক্তার বলে, আমরা স্কুলে যাওয়া-আসার পথে প্রতিদিনই বই দেয়ালের বাড়ির বইগুলো দেখি। এই বই দেওয়ালটি দেখতে দেখতে বিভিন্ন বই ও লেখকের নাম মুখস্থ হয়ে গেছে। বইগুলো দেখে বই পড়ার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। লাইব্রেরি থেকে নিয়ে বইগুলো পড়ি।

স্থানীয় আশরাফুল ইসলাম বলেন, বই-দেয়াল বাড়িটি আমাদের এলাকার সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে এখানে একটি উন্মুক্ত গ্রন্থাগার থাকলে সবাই এসব বই পড়ার সুযোগ পাবেন। এলাকাবাসী হিসেবে এই উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।

সমাজকর্মী স্বাধীন আহমেদ বলেন, প্রতিদিনই এই বাড়ি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে কিশোর-কিশোরী এবং তরুণ-তরুণীরা আসেন। বই বিমুখতা দূর করতে এমন অনন্য উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে।

বই-দেয়াল বাড়ির নির্মাতা মো. রাকিব হাসান ঢাকার একটি বেসরকারি সংস্থার উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাদক, মোবাইল গেম ও সোশ্যাল মিডিয়া ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির কারণে বর্তমান প্রজন্মের কাছে এক ধরনের বই বিমুখতা দেখা দিয়েছে। তাদের ভাবনাতেই যেন নেই মহান মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি এবং বাঙালি জীবন ও সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে কালজয়ী সব বইয়ের নাম। অথচ একজন মানুষের প্রকৃত বন্ধু হচ্ছে বই।

তাই নিজে বই পড়ার পাশাপাশি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি-প্রেক্ষাপটসহ বাঙালি জীবন এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে এক অনুকরণীয় উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। সুযোগ পেলে বইপ্রেমীদের জন্য তিনি কিছু করতে চান বলেও জানান রাকিব।

স্থানীয় গুণীজনেরা বলছেন, বর্তমান সময়ে যখন মানুষ বই বিমুখ হয়ে পড়েছে, সেখানে এক তরুণের বইয়ের প্রতি এমন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখবে।

মোহাম্মদ এনামুল হক হৃদয়/এফআরএস