‘আমি সমিতি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ কইররা দুই একর জমিনে আমন ধানের চারা লাগাইছি। জোয়ার আর বৃষ্টির পানি ক্ষেতে জইম্মা (জমে) ধানের সব চারা পচেঁ গেছে। এখন যদি সরকার সহযোগিতা না করে তাইলে আমার দেশ ছাইররা পলাতে হইবে। এছাড়া আমার আর কোনো উপায় নাই। আমার তো আর ধনসম্পদ নাই যে বেইচ্চা ধারদেনা শোধ করমু।’

জমির হাঁটু পানিতে নেমে মাথায় হাত দিয়ে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের আমন ধান চাষি মো. মোসলেউদ্দিন (৬০)। গত ২৪ দিন আগে রোপণ করা ধানের চারাগুলো পানিতে ডুবে সব পচে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তিনি।

ভোলা জেলায় মোট কৃষকের সংখ্যা ৪ লাখ ২৮ হাজার। তার মধ্যে আমন চাষিই আছেন ৪ লাখ ২৫ হাজার। অতিবৃষ্টি ও অতি জোয়ারের পানিতে তলিয়ে আছে ভোলার ৭ উপজেলার আমনের চারা ও বীজতলা। পানি দ্রুত না নেমে যাওয়ায় জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আর এতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকদের জমিতে থাকা আমনের বীজের চারা। আগামী ১০ দিনের মধ্যে যদি কৃষক পুনরায় জমিতে আমনের চারা রোপণ করতে না পারেন তাহলে এ বছর ভোলায় ১৯ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকার শঙ্কা আছে।

সরেজমিনে আমন ধানের জন্য প্রস্তুত করা জমিগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, টানা কয়েকদিন জমিতে পানি জমে থাকায় আমন ব্রি ধান-৫২, বি আর- ১১, ২২, ২৩, ব্রি ধান ৭৬, স্বর্না, বিনা- ১৭ ও ২০ ধানের চারা এবং বীজতলা কোথাও সম্পূর্ণ ও কোথাও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রোপণ করা কিছু জমি থেকে জোয়ারের পানিতে চারা ভেসে গেছে। এছাড়া পানিতে ডুবে থাকায় অনেক চারা পচে গেছে। ফলে অনেক জমি চারাশুন্য হয়ে গেছে। আর এতেই লোকসানের মুখে পড়েছেন আমন ধান চাষিরা।

জোয়ারের পানির চাপ ও বৃষ্টিপাত বন্ধ হওয়ায় মাঠ থেকে পানি নামতে শুরু করায় মাঠে ফসলের ক্ষতি দৃশ্যমান হচ্ছে। কৃষকরা এখন দিশেহারা পড়েছেন। কেউ মাথায় হাত দিয়ে কাঁদছেন। আবার কেউ সরকারি সহায়তার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমনই অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ভোলার আমন চাষিরা।

ভোলা সদর উপজেলার ধনিয়া ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষক মিরাজ জানান, আমার দেড় একর জমির জন্য ১৮ শতাংশ জায়গায় বীজতলা করেছিলাম। পানিতে সব একেবারে শেষ হয়ে গেছে। একটা বীজও জমিতে লাগাইতে পারলাম না। এখনই চারা রোপণ করার শেষ সময়। অন্য জেলা থেকে আমনের চারা সংগ্রহ করা যাবে। কিন্তু এতে খরচ অনেক বেশি পড়বে। আমাদের মতো গরীব মানুষদের দ্বারা অন্য জেলা থেকে চারা কিনে এনে রোপণ করা সম্ভব না।

ভেলুমিয়া ইউনিয়নের ছিদ্দিক মিয়া জানান, আমি ৩২ হাজার টাকা খরচ করে প্রায় এক একর জমিতে আমনের চারা লাগিয়েছিলাম। পানিতে সব চারা পচে গেছে। এখন যদি কোথাও চারা পাই তাহলে জমিতে রোপণ করতে পারবো। নইলে জমি অনাবাদি পড়ে থাকবে। আশা ছিল ধান বিক্রি করে দেনা শোধ করবো আর বাকি ধান খোড়াঁকি হিসেবে ঘরে রাখবো। পানি সব আশা শেষ করে দিয়েছে। এখন সরকারিভাবে যদি চারা পাই, তাহলে চাষাবাদ করতে পারবো।

ইলিশা ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল মালেক জানান, আমার ১২ শতাংশ জমির বীজতলা নষ্ট হয়ে গেছে। জমি তৈরি করে রেখেছি। চারার অভাবে কিছু করতে পারছি না। যদি এ বছর আমন না করতে পারি তাহলে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হবে। কৃষিকাজ ছাড়া তো আর কোনো কাজও জানি না।

ধনিয়া ইউনিয়নের কৃষক মো. জাহাঙ্গীর জানান, ছোট থেকেই কষি কাজ করি। কৃষির আয় ব্যয় দিয়েই সংসার চলে। ক্ষেতে ফসল ভালো হইলে অনেক আনন্দ লাগে। সুদের উপর ২৫ হাজার টাকা নিয়ে ক্ষেতে আমন ধানের চারা লাগাই। এর কয়দিনের মাথাতেই সব চারা পচে গেছে।

ভোলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর খামারবাড়ি অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্ভিদ সংরক্ষণ) কৃষিবিদ এ এফ এম শাহাবুদ্দিন বলেন, চলমান ক্ষরিক-২ মৌসুমে আমাদের আমনের বীজতলার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১২ হাজার ৩৪১ হেক্টর। কিন্তু অতিবৃষ্টি ও অতি জোয়ারের পানিতে ৩ হাজার ৪৩১ হেক্টর বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চলতি বছরে ভোলা জেলায় আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৯৭৬ হেক্টর জমিতে। ইতোমধ্যে আবাদ সম্পন্ন হয়েছে ৬৪ হাজার ৬৯২ হেক্টরে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৩০ হাজার ৪৫০ হেক্টর। এ পরিস্থিতিতে জেলায় ১৯ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমি অনাবাদি থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকতার কাছে স্বল্প জীবনকালীন ধান ব্রি- ৬১, ৭১, ৭৫ জাতের চারার জন্য লিখিতভাবে আবেদন করেছি। যদি আগামী ১০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেগুলো পাই তাহলে আর এ বছর আমন আবাধ ব্যাহত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।

ঘুরে দাঁড়াতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনা দেওয়া হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি জানান, আগামী নভেম্বরের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের রবি ফসলের মাধ্যমে প্রণোদনার আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে যাতে কৃষকরা ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।

এফআরএস