স্বল্প খরচ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় কলাচাষ লাভজনক হওয়ায় মেহেরপুরে বেড়েছে কলার আবাদ। উৎপাদিত মেহেরসাগর জাতের কলার চাহিদা ও খ্যাতি এখন দেশজুড়ে। বাণিজ্যিকভাবে মেহেরসাগর জাতের কলা চাষ ও বিকিকিনির সঙ্গে জড়িয়ে সচ্ছলতা ফিরেছে মেহেরপুরের কয়েক হাজার কৃষক পরিবারে। মাটি ও আবহাওয়া মেহেরসাগর জাতের কলা চাষের উপযোগী হওয়ায় একবার চারা রোপণ করে বছরে তিনবার কলা বিক্রি করতে পেরে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। তারা বলছেন, একবার চারা রোপণ করে তিনবার কলার ফলন পাওয়া যায়। খরচ কম অথচ লাভ বেশি, তাই মেহেরপুরের চাষিরা কলাচাষে ঝুঁকে পড়েছেন।

মেহেরপুর সদর উপজেলার বন্দর, আমদহ, চকশ্যামনগর, আশরাফপুর, নূরপুর, পিরোজপুর, টুঙ্গী, কাঁঠালপোতা, সোনাপুর, বলিয়ারপুর, গহরপুর, কলাইডাঙ্গা, যুগিন্দা, রাজনগর, আমঝুপি ও চাঁদবিল এবং মুজিবনগর উপজেলার মোনাখালী, দারিয়াপুর, গৌরিনগর, পুরন্দরপুর, গোপালনগর, বাগোয়ান, আনন্দবাস, মহাজনপুর, গোপালপুর, কোমরপুর, গোপালপুর ও যতারপুর গ্রামের মাঠে প্রচুর পরিমাণ কলার চাষ হয়েছে। গাংনী উপজেলার কিছু কিছু মাঠেও কলার চাষ হচ্ছে। আশির দশক থেকে মেহেরপুরে বাণিজ্যিকভাবে কলা চাষ হলেও বর্তমানে মেহেরপুরের কৃষকদের কাছে কলা আবাদ এখন একটি অন্যতম অর্থকরী ফসল হিসেবে নিচ্ছেন কৃষকরা। তবে মেহেরপুর জেলার নামানুসারে মেহেরসাগর কলার কদর দিন দিন বাড়ছে। এ জাতের কলা কাঁচা অবস্থায় গাড়ো সবুজ, আবার পাকলেও দেখতে সবুজ।

জেলা কৃষি বিভাগের হিসাব মতে, গেল মৌসুমে জেলায় কলার চাষ হয়েছে ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৫০ হাজার টন। চলতি মৌসুমে কলার আবাদ বেড়ে ২ হাজার ৫৯০ হেক্টর। যার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৮৫ হাজার টন। এ বছর কলার দাম ভালো পাচ্ছেন কৃষকরা। আগামীতে কলা চাষ আরও ছাড়িয়ে যাবে বলে জেলা কৃষি বিভাগের ধারণা।

মুজিবনগর উপজেলার ভবেরপাড়া গ্রামের কলা চাষি লালচাঁদ বিশ্বাস জানান, স্থানীয় কৃষি বিভাগের পরামর্শে ৪০০ জয়েন্ট গভর্নর কলার চারা আমদানি করে এক বিঘা জমিতে চাষ করেছিলেন। সেই এক বিঘা কলায় অল্প টাকা খরচ করে ভালো লাভ হয়। পরে গেল দুই বছর থেকে মেহেরসাগর জাতের কলার আবাদ করি। এ জাতের কলা বড়, সুস্বাদু এবং রং সুন্দর হওয়ায় দেশের সব জেলাতেই কলার চাহিদা অনেক বেশি। দুই বিঘা জমিতে মেহেরসাগর জাতের কলা লাগিয়েছিলাম। প্রথমবারেই খরচের টাকা বাদ দিয়ে লাভ হয়েছে দ্বিগুণ। ওই জমি থেকে এখনও দুইবার কলা পাওয়া যাবে।

কৃষক বজলুর রহমান বলেন, বর্তমানে এ জেলা থেকে প্রতিদিন ট্রাকভর্তি হয়ে কলা দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই গাছ থেকে কলা কেটে কাঁদি হিসেবে কলা বিক্রি করছি। প্রতি কাঁদি কলা বিক্রি হচ্ছে ৪০০ টাকা থেকে সাড়ে ৪০০ টাকায়।

মহাজনপুর গ্রামের চাষি লিটন হোসেন, তিনি এক বিঘা জমিতে মেহেরসাগর কলার আবাদ করেছেন। কোনো রাসায়নিক সার না দিয়ে পাঁচ ট্রলি গোবর সার দিয়েছেন।

তিনি জানান, প্রতিবছরের পৌষ মাসে কলার চারা রোপণ করার উপযুক্ত সময়। মাঘ মাসে এই চারা জমিতে লেগে গেলে একটি সেচ দিতে হয়। মাটি ঝরঝরে হলে জমি কুপিয়ে দিতে হবে। এরপর গাছের গোড়া থেকে বের হওয়া চারা কেটে দিতে হবে। এভাবে একটু যত্ন আর গবাদিপশুর আক্রমণ ও কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলেই হাসি ফুটবে চাষির মুখে। তার হিসাবে, এক বিঘা জমিতে কলার চাষ করতে প্রথম বছরে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিবিঘা জমিতে প্রতিবছর ৪০০ থেকে ৪৫০ কাঁদি কলা পাওয়া যায়। যা খেত থেকে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করলে ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এভাবে দুই বছরে মোট তিনবার কলা পাওয়া যাবে। পরের দুইবার সার-বিষ ও পানি সেচ বাবদ সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা করে খরচ করলে যথেষ্ট। 

কলা চাষ লাভজনক হওয়ায় একই এলাকার চাষি আব্দুর রহমান জানান, আমাদের এলাকার হোসেন আলী তিন বিঘা, ইয়ারুল ইসলাম পাঁচ বিঘা, আহাজদ্দির ছয় বিঘা, বান্টু মিয়া চার বিঘা, আক্তারুল ইসলাম দুই বিঘা জমিতে কলা চাষ করেছেন। আগামী মৌসুমে তিনি নিজেও কয়েক বিঘা জমিতে কলা চাষ করবেন বলে জানান।

বরিশাল থেকে মেহেরপুরে আসা কলা ব্যবসায়ী আব্দুস সোবহান বলেন, মেহেরপুরের কলার চাহিদা বরিশাল, ঢাকা, রাজশাহী, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রয়েছে। আমি মেহেরপুর থেকে প্রতি মাসে কমপক্ষে চার ট্রাক কলা বরিশালসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠাই।

মুজিবনগরের কলা ব্যবসায়ী মোফাজ্জেল হোসেন বলেন, আমি প্রায় নব্বই দশক থেকে কলার ব্যবসা করি। প্রতিদিনই ট্রাকভর্তি করে কলা নিয়ে যাই ঢাকা, চট্রোগ্রাম, সিলেট, বরিশালসহ বিভিন্ন বড়বড় জেলা ও বিভাগীয় শহরে। বর্তমানে মেহেরপুরের উৎপাদিত মেহেরসাগর কলার চাহিদা অনেক বেশি এবং দামও ভালো। বাজারে গেলে মেহেরপুরের কলা আগে বিক্রি হয়ে যায়। কলা ব্যবসায় থেকে আমার পরিবারের খরচ চালানো হয়।

দারিয়াপুর গ্রামের ব্যবসায়ী খোকন মিয়া বলেন, শুধু আমি না, জেলায় প্রায় দুই শতাধিক কলা ব্যবসায়ী রয়েছেন যারা কৃষকদের কাছ থেকে পাইকারি দামে কলা কিনে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করে সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন এবং অনেকের ছেলে-মেয়ে লেখা-পড়া করছেন।

মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচারক বিজয় কৃষ্ণ হালদার বলেন, লাভজনক হওয়ায় মেহেরপুরের চাষিরা কলার চাষ করছেন। মেহেরপুরে জয়েন্ট গভর্নর, মেহেরসাগর, দুধসর, সবরি, চাঁপা, চিনিচাঁপাসহ বিভিন্ন ধরনের কলার চাষ হচ্ছে। সম্প্রতি কৃষি বিভাগ তরকারি খাওয়ার জন্য উন্নত জাতের কাঁচকলা চারা সরবরাহ ও চাষ করার জন্য চাষিদের উদ্বুদ্ধ করছেন। তবে তিনি একই জমিতে ২৪ মাসের বেশি কলার চাষ না করতে চাষিদের পরামর্শ দেন। এতে জমির উর্বরতা শক্তি মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। 

তিনি আরও বলেন, কলা চাষিদের বিভিন্ন সমস্যা ও সমাধানে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সারাদিন মাঠে থাকছেন। চাষিদের কলা চাষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিচ্ছেন তারা। অন্যদিকে ব্যবসায়ী ও কৃষকদের কলাতে কার্বাইড ও বিষ স্প্রে না করার জন্যও পরামর্শ দেন।

এএমকে