বছরে তিস্তায় পড়ছে দুই কোটি টন পলি, কমছে পানির ধারণক্ষমতা
বাংলাদেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য বিভাগ রংপুর। আর দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্য ও গরিব জেলাগুলোর পাঁচটিই রয়েছে সর্বনাশা তিস্তাজুড়ে। ভারতের সিকিম থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়া পাগলা নদীখ্যাত তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধা জেলার বুক চিরে। এখানকার লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার নাম এই নদী। ২৩৭ বছর বয়সী তিস্তার প্রবাহ এই পাঁচ জেলার বুক চিরে প্রতিবছরই ডেকে আনছে বন্যা ও খরা। এতে মানুষের দীর্ঘশ্বাস ভারী হচ্ছে, প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে দুই পাড়ের জীবনচক্র।
প্রতিবছর সময়-অসময়ের বন্যায় পানির ধারণক্ষমতা কমে গেছে তিস্তা নদীর। উজানের পলিতে ভরাট হয়েছে নদীর বুক। ফলে বর্ষায় ভারতে ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিতে তিস্তায় বন্যা দেখা দিচ্ছে। ফসল, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। অপরদিকে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তা নদী শুকিয়ে মরা খালে পরিণত হচ্ছে। অনেক স্থানে হেঁটে নদী পারাপার হন স্থানীয়রা। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, প্রতিবছর দুই কোটি টনের বেশি পলি আনছে তিস্তা।
বিজ্ঞাপন
জানা যায়, বর্ষা মৌসুমে বেশি বৃষ্টি হলে গজলডোবা বাঁধের সব জলকপাট খুলে দেয় ভারত। এতে হু হু করে পানি ঢুকে পড়ে তিস্তা নদীতে। পানির চাপ বেশি হলে লালমনিরহাটের তিস্তা ব্যারাজের সব জলকপাট খুলে দিতে হয় কর্তৃপক্ষকে। এতে করে নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধায় জেলায় বন্যা দেখা দেয়। বন্যার ঘোলাটে পানির স্রোত ধেয়ে আসতে থাকে ভাটির দিকে। এর সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি আসায় তিস্তা নদীর বুক ভরাট হয়ে এসেছে। ফলে প্রতিবছর নতুন নতুন চর জেগে উঠছে। বিদ্যমান চরগুলো আরও উঁচু হচ্ছে। পলিতে নদীর বুক উঁচু হওয়ায় স্বল্প পানিতেই নদী টইটম্বুর হয়। পানি ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। পথঘাট, ঘরবাড়ি সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সেই সঙ্গে বর্ষা ও শরৎকালে বারবার ক্ষণস্থায়ী বন্যায় ভাসতে হয় তিস্তাপাড়ের মানুষকে। নষ্ট হয় তাদের জীবিকার একমাত্র পথ চরের কৃষি। নদীর বুকে চর জেগে ওঠায় রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নে তিস্তা নদী একাধিক চ্যানেল দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীশাসন, ড্রেজিং না হওয়ায় প্রতিবছর নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা বাড়ছে। তিস্তার বুক পলিতে ভরে যাওয়ায় কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা পরিবর্তন করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। পূর্বে কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ছিল ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। গত জুন মাসে এ পয়েন্টে বিপৎসীমা ৫৬ সেন্টিমিটার বাড়িয়ে ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার নির্ধারণ করা হয়েছে।
রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের মহিপুর এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, ভারতে ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে এখন ভরা যৌবনে ফিরেছে তিস্তা নদী। প্রবল বেগে নদীর পানি বয়ে চলেছে। ঘোলা পানির কারণে বোঝা যাচ্ছে উজান থেকে পলি বয়ে আনছে তিস্তা। শংকরদহ গ্রামের কিছু এলাকায় তিস্তা নদীর পানি ঢুকে পড়েছে।
এলাকার আসিফ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই যে দ্যাখতোছেন তিস্তার পানি। সউগ কিন্তু ঘোলা। মানে নদীর পানির সাতে ম্যালা মাটিও আসতোছে। শুকানের সময় এই মাটি দেখা যায়। নদী তো মাটিত ভরি গেইছে। হামরা নদীর মাঝোত সেই মাটিত আবাদ করি। নদী ভরাট হয়া গেইছে, সেই জন্তে অল্প একনা পানিতেই হামরা ভাসি যাই।’
এলাকার বাসিন্দা ধীরেন্দ্র নাথ বলেন, ‘আগোত নদী ম্যালা গভীর ছিল। বড় বড় নৌকা যাতায়াত করছিল। এ্যালা তো গভীরতা নাই। শুকানের দিনোত মানুষ হাঁটি নদী পার হয়। নদী পার হয়া ঘোড়া গাড়িত করি হামরা বাড়িত ফসল নিয়া যাই।’
শংকরদহের কৃষাণী আমিনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘দৌড়ি নদীত পানি বাড়ে, হামরা বাঁন্দোত দিন-আইত কাটাই। আবার পরের দিন পানি কমি গেইলে বাড়িত উঠি। আবার দেখা যায় আইতো ভারত পানি ছাড়ি দেয়। বৃষ্টির দিনোত হামাক দৌড়াদৌড়ির উপর থাকা নাগে।’
চর ইছলিতে কথা হয় কৃষক মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘হামরা নদীপাড়ের মানুষ। সুখ-দুক্কের হিসাব করার সময় নাই। খরা, বান-সাঁতাওয়ের সঙ্গে হামার বসবাস। এ তিস্তা নদী হামাক কোনো সময় কান্দায়, ফির হাসায়। নদীত আর আগের মতো গভীরতা নাই। বছরে বছরে পলিবালু পড়ি পড়ি নদীর বুক ভরাট হওছে। সরকার তো নদী খননসহ তিস্তা মহাপরিকল্পনার কতা কছলো কিন্তুক কাম করে নাই। এ্যলা বন্যা হইলে ঘোলা পানি বেশি আইসে।’
৩১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকার ১১৫ কিলোমিটার পড়েছে বাংলাদেশে। তিস্তা আন্তর্জাতিক নদী হওয়া সত্ত্বেও ভারত একতরফা বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং প্রায় ছয় লাখ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য পানি প্রত্যাহার করে নেওয়ার পর বাংলাদেশের জন্য পানি ছাড়ে। যে পানি আশীর্বাদ না হয়ে বেশির ভাগ সময়ে এ দেশের মানুষের জন্য বয়ে আনছে অভিশাপ। ফলে অসময়ে তিস্তাপাড়ে বন্যা দেখা দিচ্ছে, বছর বছর বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।
এমন পরিস্থিতিতে নদী গবেষক ও উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, নদীকেন্দ্রিক কৃষিজমি রক্ষা, ভাঙন রোধসহ চরগুলো রক্ষায় সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো উজানের পলিতে নদীর বুক ভরাট হলে স্বল্প পানিতে প্রতিবছর অনাকাঙ্ক্ষিত বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ বাড়তেই থাকবে। তারা মনে করছেন, তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যার যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি তিস্তা নদীর সুরক্ষার বিষয়টিও এখন জরুরি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড জানায়, উজানের ঢলের সঙ্গে প্রতিবছর দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে তিস্তা নদী। এতে করেই তিস্তা নদীর বুক ভরাট হচ্ছে এবং স্বল্প বৃষ্টিতেই বন্যা দেখা দিচ্ছে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ভেঙে যায়। ফলে তিস্তা নদীতে সেই বাঁধ ভাঙা পানি প্রবাহিত হয়। ওই বছর ব্যাপক পরিমাণ পলি বয়ে আসে তিস্তা নদীতে।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পাহাড়ি ঢল থেকে তিস্তা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। প্রতিবছর তিস্তা নদী দুই কোটি টন পলি বয়ে আনে। গত বছর অক্টোবরে ভারতে বাঁধ ধসের কারণে বিপুল পরিমাণ পলি এসেছে। ফলে তিস্তা নদীর বুক উঁচু হয়েছে। তাই অল্প পানিতেই উত্তরের পাঁচ জেলায় বন্যা দেখা দিচ্ছে।
নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তুহিন ওয়াদুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ১৭৮৭ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় তিস্তা নদীর প্রবাহের সৃষ্টি। ২৩৭ বছর আগে তৈরি হওয়া এ নদীর আজ অবধি কোনো পরিচর্যা করা হয়নি। ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তান পর্ব ও বাংলাদেশ যুগের কোনো সময়েই এ নদীর সঠিক পরিচর্যা হয়নি। বরং দফায় দফায় এ নদীর সর্বনাশ করার নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে যে নদী হয়ে ওঠার কথা ছিল উত্তরের জীবনরেখা, সেটা হয়ে উঠেছে অভিশাপ। নদীকে যদি আমরা অভিশাপের হাত থেকে আশীর্বাদে পরিণত করতে চাই, তাহলে এ তিস্তা নদীর সুরক্ষা অত্যন্ত প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, উত্তরের জীবনরেখা তিস্তা নদী। এটি নিয়ে এখন পর্যন্ত যৌথ কোনো সমীক্ষা হয়নি। তিস্তা ১০ হাজার কিউসেক পানি ধারণ করতে পারে। কিন্তু সেখানে ওই পরিমাণে পানি শুষ্ক মৌসুমে আসে না। প্রতিবছর উজানের ঘোলা পানির সঙ্গে আসা পলি, পাথরসহ ময়লা-আবর্জনায় তিস্তার বুক ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এখন আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নদী ড্রেজিং করতে হবে।
ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, তিস্তার পানি ভারত গজলডোবা বাঁধ দিয়ে আটকে না রাখলে তা বঙ্গোপসাগরে চলে যেত। একদিকে পানির প্রবাহ নেই, অপরদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। তাই সাগরের লবণাক্ত পানি দিন দিন লোকালয়ে উঠে আসছে। লবণাক্ত পানির কারণে দক্ষিণবঙ্গে আমাদের ফসল আবাদ হচ্ছে না। এ ছাড়া পানির কারণে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিচ্ছে। বাংলাদেশের উচিত আন্তর্জাতিক পানি কনভেনশনে স্বাক্ষর করে তিস্তার মতো যৌথ নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করা।
তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারত থেকে ধেয়ে আসা উজানের ঢলে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা অববাহিকায় প্রায়ই অসময়ে বন্যা হচ্ছে। বন্যা ও নদীভাঙনের ভয়াবহতায় এ অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি হুমকির মুখে। খরাকালে গজলডোবায় বাঁধ দিয়ে শুকনো মৌসুমে পানি আটকে রাখে ভারত। আবার একটু পানি বেশি হলেই বাংলাদেশকে কিছু না জানিয়ে গজলডোবার গজবে ভাসাচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষদের। এতে প্রতিবছর ব্যাপক ফসলহানি ঘটছে। হুমকিতে পড়ছে খাদ্যনিরাপত্তা। নদীভাঙনে বাড়ছে উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা, বাড়ছে রংপুর বিভাগে গড় দারিদ্র্যের হার।
তিনি আরও বলেন, আন্তঃদেশীয় ব্যবস্থাপনায় তিস্তা অববাহিকার ভারত-বাংলাদেশ মিলে নদী ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে না পারা এবং দেশীয় ব্যবস্থাপনায় নদী খনন, ভাঙন রোধে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে না পারায় তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশের ১১৫ কিলোমিটারে বসবাসরত দুই কোটি মানুষের জীবনে মহাদুর্যোগ নেমে এসেছে। অথচ তিস্তাকে ঘিরে এ অঞ্চলের কোটি মানুষের জীবন-জীবিকা চলে। তিস্তা যদি আরও মরে যায় তাহলে কোটি মানুষের জীবন বিপন্ন হবে।
নজরুল ইসলাম হক্কানী বলেন, তিস্তায় সারা বছর পানির প্রবাহ ঠিক রাখা, ভাঙন, বন্যা, খরায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকসহ অসহায় মানুষের স্বার্থ সংরক্ষণ এখন সময়ের দাবি। এ দাবি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলে তিস্তাবেষ্টিত জনজীবন, কৃষি ও প্রকৃতি চরম হুমকির মুখে পড়বে। পানি বঞ্চিত রেখে উত্তরের জনজীবন, কৃষি ও প্রকৃতিকে তিলে তিলে হত্যা করা হচ্ছে। এই হত্যা থামাতে হবে। তিস্তা বাঁচাতে শুধু আশ্বাস নয়, চুক্তির মাধ্যমে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে।
এমজেইউ