রাজবাড়ীতে বেশিরভাগ সড়কেরই বেহাল দশা, অর্ধলক্ষ মানুষের ভোগান্তি
দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে রাজবাড়ী পৌরসভার অধিকাংশ রাস্তারই বর্তমানে বেহাল দশা। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই এসব খানাখন্দে ভরা রাস্তা তলিয়ে যায় পানিতে। এসব সড়কে মাঝে মধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। তখন মানুষের দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। সামান্য বৃষ্টিতে সড়কে জমে থাকে পানি। পায়ে হেঁটে চলাচল করতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় পথচারীদের। নিয়মিত ড্রেনগুলো পরিষ্কার না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে জানান পৌরবাসী।
পৌরবাসীর অভিযোগ, প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হওয়া শর্তেও সেই নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা। প্রতিবছরই পৌরসভার পক্ষ থেকে কয়েকটি রাস্তা দায়সারা লোক দেখানো সংস্কার করা হয়। কিন্তু সংস্কারের কয়েক মাস যেতে না যেতেই রাস্তাগুলো পুরোনো রূপে ফিরে পায়। প্রায় প্রতিদিনই খনাখন্দের রাস্তায় যানবাহন চলাচলে ছোটখাটো দুর্ঘটনা ঘটে। বিকল হয় যানবাহনের যন্ত্রাংশ।
বিজ্ঞাপন
জানা গেছে, রাজবাড়ী পৌরসভাটি ১৯১৩ সালে স্থাপিত হয়। তখন প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল টাউন কমিটি। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে এর নাম হয় রাজবাড়ী মিউনিসিপ্যালিটি। ১৯৭২ সালে রাজবাড়ী মিউনিসিপ্যালিটি রাজবাড়ী পৌরসভায় নামকরণ হয়। পরবর্তীতে তা প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হয়। প্রায় ১১.৬৬ বর্গ কিলোমিটারের এই পৌরসভায় বর্তমানে ৬৫ হাজার ৪১০ জন মানুষের বসবাস পৌরসভায়। বর্তমানে পৌর নাগরিকদের ট্যাক্স বাড়লেও বাড়েনি নাগরিক সুবিধা। সামান্য বৃষ্টি হলেই পৌরসভার রাস্তায় পানি জমে।
রাজবাড়ী পৌরসভার দেওয়া তথ্যমতে, পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের ১০৮ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ৬৮ কিলোমিটার রাস্তার অবস্থাই বেহাল। বাকি রাস্তাগুলোর অবস্থাও নাজুক। প্রাথমিক পর্যায়ে ৬৮ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কার করা জরুরি। সর্বশেষ পৌরসভার রাস্তাগুলো ৫ থেকে ৭ বছর আগে ইউজিআইআইপি-৩ প্রকল্পের আওতায় সংস্কার করা হয়। সর্বশেষ আইওআইডিবি ও এলজিসিআরআর প্রকল্পে ১৮ কোটি টাকার কাজ হয়। এরপর রাজবাড়ী পৌরসভায় রাস্তা সংস্কারে আর কোনো কাজ হয়নি।
কয়েকবছর ধরে টাকার অভাবে এসব রাস্তা সংস্কার করতে পারেনি পৌর কর্তৃপক্ষ। যার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। সাম্প্রতিক সময়ে এডিবি থেকে ৩শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প আসার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি আসলে পৌরসভার উন্নয়নমূলক কিছু কাজ হবে।
সরজমিনে দেখা যায়, রাজবাড়ী পৌর এলাকার পাবলিক হেলথ থেকে হাসপাতাল গেট হয়ে ২নং রেলগেট পর্যন্ত সড়কের বেহাল অবস্থা। এই জনগুরুত্বপূর্ণ সড়কে রয়েছে মসজিদ, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, প্রাইভেট ক্লিনিক, বিদ্যুৎ অফিস, ব্যাংকসহ নানা স্থাপনা। এই সড়কের পাবলিক হেলথ মসজিদ থেকে সদর হাসপাতাল পর্যন্ত খানাখন্দে ভরা। একটু বৃষ্টি হলেই ডুবে যায় সড়ক।
এ ছাড়াও রাজবাড়ী রেলগেট-উড়াকান্দা বেড়িবাঁধ রুটে প্রতিদিন কয়েকশ অটেরিকশা, রিকশা, ভ্যানসহ বিভিন্ন যানবাহন যাতায়াত করে থাকে। এই সড়কের রেলগেট থেকে নুরপুর পর্যন্ত সড়কের খুবই বেহাল অবস্থা। রেলগেট থেকে হরিজন পল্লী হয়ে গরুহাটা, এতিমখানা, সোহান ব্রিকস, লোকো ব্রিজ, নূরপুর পর্যন্ত সড়কের অর্ধেক স্থানজুড়েই ভাঙাচোরা। বিভিন্ন স্থানে পিচ উঠে কোথাও খোয়া, কোথাও মাটি বেরিয়ে গেছে। আবার কোথাও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
শুধু হাসপাতাল রোড বা উড়াকান্দা সড়ক নয়, পৌরসভার মধ্যে ড্রাইস ফ্যাক্টরি রোড, গোদারবাজার রোড, টেকনিক্যাল থেকে শ্রিপুর বাজার রোড, দক্ষিণ ভবানীপুর রোড, ধুন্চি রোড সহ পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি সড়কেরই বেহাল দশা।
পৌরসভার ৫নং ওয়ার্ডের পাবলিক হেলথ এলাকার বাসিন্দা ডিসের টেকনিশিয়ান মানিক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের পৌরসভার থেকে ইউনিয়ন ও গ্রামের রাস্তাগুলোও অনেক ভালো। পৌরসভার কোনো ওয়ার্ডের রাস্তাই ভালো না। এই মেয়র আসার পর চার আনার কাজও করে নাই। রাস্তাঘাট ভাঙা, খালের এমন অবস্থা হয়েছে হেঁটে যাওয়াও মুশকিল, মানুষ গুঁতা খেয়ে পড়ে যায়। গাড়িতে করে হাসপাতালে রোগী কীভাবে নিয়ে যাবেন, রাস্তার যে অবস্থা এতে গর্ভবতী নারীদের রাস্তাতেই ডেলিভারি হয়ে যাবে।
আরেক পথচারী শহীদুল হক বলেন, রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থা, চলা যায় না। যেখানে-সেখানে পুকুরের মতন গর্ত। রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটা যায় না। রেলগেট থেকে হাসপাতাল পর্যন্ত ও পাবলিক থেকে ভেতর দিয়ে শ্রিপুর পর্যন্ত রাস্তার করুণ অবস্থা। গাড়ি নিয়ে যাওয়া খুব মুশকিল। মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। রাস্তার অবস্থা খারাপের কারণে রিকশা, ভ্যান ও অটোতে রোগী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায় না। আমরা দ্রুত পৌরসভার সব রাস্তার সংস্কার চাই।
রিকশাচালক ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, পৌরসভার রাস্তার করুন দশা। আমাদের রিকশা চালাতে কষ্ট হয়। খানাখন্দের ভেতর দিয়ে রিকশা চালালে চাকা টাল হয়ে যায়, চেসিস ভেঙে যায়। আবার ভাঙা রাস্তা দিয়ে ভাড়া নিতে না চাইলে পাবলিক ক্ষেপে যায়। তখন বাধ্য হয়ে ভাঙা রাস্তা দিয়ে যেতে হয়। সাবেক মেয়র মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর সময়ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়নি। আবার তিতু মেয়র হলো, কিন্তু রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করতে পারল না।
হরিজন পল্লী এলাকার বাসিন্দা দিপ্ত কুমার বলেন, পাঁচ-ছয় বছর আগে ২নং রেলগেট থেকে গরু হাঁটার রাস্তা মেরামত করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন মেরামত না করাতে রাস্তায় খানাখন্দ ও গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়। তখন হাঁটাচলা করতে কষ্ট হয়। আমরা দ্রুত এই রাস্তার সংস্কার চাই।
বিনোদপুর এলাকার বাসিন্দা খায়রুল ইসলাম খায়রু বলেন, ২নং রেলগেট থেকে নূরপুর পর্যন্ত এই রোডে একটি রিকশা যাওয়ার মতো অবস্থা নেই। এই সড়ক দিয়ে অন্তরমোড় হয়ে পাচুরিয়া,গোয়ালন্দের যানবাহন চলাচল করে থাকে। এই রোডের যে অবস্থা তাতে একটি রিকশা, ভ্যান চলাচলের অবস্থা নেই। বিগত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার শুধু মুখেই উন্নয়ন আর উন্নয়ন বলেছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা পৌরবাসী কোনো উন্নয়নের ছোঁয়া পাইনি।
রাজবাড়ী পৌরসভার ২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল্লাহ আল মামুন সম্রাট বলেন, এতদিন আমাদের কোনো কথা বলার সুযোগ ছিল না। মেয়রের অপসারণের পর নতুন প্রশাসনিক কর্মকর্তার নিয়োগ হয়েছে। আমরা তার সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেছি। তাকে পৌরসভার রাস্তাঘাটের অবস্থা সম্পর্কে জানিয়েছি। আমাদের পৌরসভার রাস্তাঘাটের অবস্থা খুবই খারাপ। নতুন বাংলাদেশে আমরা নতুন করে শুরু করতে চাচ্ছি। আমরা পৌরসভার উন্নয়ন চাই। মানুষ আমাদেরকে ভুল বোঝে। আমরা যারা কাউন্সিলর রয়েছি, তাদের অর্থনৈতিকভাবে সিগনেচার পাওয়ার নেই। আমরা সমস্যার কথা মেয়রকে বলি। মেয়র যদি কোনো প্রজেক্ট না নিয়ে আসতে পারে তাহলে তো উন্নয়ন সম্ভব নয়। নতুন প্রশাসককে আমরা শহরটাকে নতুন করে সাজানোর কথা বলেছি। রাস্তাঘাট, পানি ও বিদ্যুৎসহ যেই নাগরিক সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলো যাতে আমরা অচিরেই দূর করতে পারি সেজন্য আমরা প্রশাসককে সহযোগিতা করবো। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, পৌরসভার নাগরিক সমস্যাগুলো অচিরেই দূর করবেন।
রাজবাড়ী পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ২য় প্যানেল মেয়র জহির রাজ বলেন, পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডের রাস্তাঘাটের যে বেহাল অবস্থা, তাতে জনমনে আমাদের প্রতি ও রাজবাড়ী পৌরসভার প্রতি অনাস্থা আনার মতো অবস্থা। আমার ৯টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটি জায়গা ঘুরে দেখা। প্রত্যেকটি ওয়ার্ডের রাস্তাই খারাপ৷ জনজীবন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে। এই বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা এবং চাওয়া আমাদের রাস্তাগুলো জনগণের কল্যাণের জন্য, জনগণের যে আশা দিয়ে আমরা আসছি, সেগুলো পূরণ করতি পারি এই প্রত্যয়ে সবাইকে উদাত্ত আহ্বান করছি।
রাজবাড়ী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মো.তায়েব আলী বলেন, পৌরসভার রাস্তাঘাটের বেহাল দশা। প্রচণ্ড পরিমাণে জনদুর্ভোগ আছে। আমরা এগুলো উত্তরণের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। আমরা বর্তমানে প্রজেক্টভুক্ত হলেও এখনো কোনো ফান্ড পাইনি। আশা করছি, আমরা অনতিবিলম্বে ফান্ড পাব। এরপর আমরা পৌরবাসীর যে আকাঙ্ক্ষা ও সমস্যা আছে, সেগুলো নিরসন করব। পৌরসভাতে প্রশাসক মহোদয় আসছেন। তার নির্দেশনায় ও আমাদের পরিষদের সহযোগিতায় সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রাজবাড়ী পৌরসভাকে মডেল পৌরসভা হিসেবে রূপান্তরিত করবো।
মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/রাজবাড়ী