ভারতের উজান থেকে নেমে আসা ঢলে কুমিল্লার গোমতী নদীর পানি বিপৎসীমার রেকর্ডসংখ্যক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উচ্চ প্রবাহের ফলে ভেঙে গেছে নদীর বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকার বাঁধ। এতে বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে, পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন লাখ লাখ মানুষ।

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) দিনগত রাত ১২টার দিকে নদীর বেড়িবাঁধের বুড়িচং উপজেলার ষোলনল ইউনিয়নের বুড়বুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে পড়ে। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম।

শুক্রবার (২৪ আগস্ট) সকালে ভেঙে পড়া বাঁধ এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বাঁধের অন্তত ২০০-২৫০ ফুট অংশ পুরো ধসে গেছে। ধসে পড়া বাঁধ দিয়ে অবিরত পানির স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। পানির এমন প্রবাহের ফলে বুড়িচং উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন এবং পাশের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামসহ অন্তত ৪০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর আতঙ্কিত মানুষজন বেড়িবাঁধের ভাঙন থেকে ২ কিলোমিটার দূরে সড়কের ওপর খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেন। অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিলেও আটকে পড়া বেশ সংখ্যক মানুষ খোলা আকাশের নিচে কোনো রকমে জীবন নিয়ে ফেরেন।

শুক্রবার সকালে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া সেসব মানুষদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের।

শিরিন বেগম নামে এক পঞ্চাশোর্ধ নারী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার কোনো ছেলে নেই। দুইটা মেয়ে। স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। কোনোরকমভাবে একটা ঘর তৈরি করেছিলাম। রাতে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে কোনোরকম জীবন বাঁচিয়ে রাস্তায় আসি। আমার সব শেষ হয়ে গেল।

হেলানা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, জীবনে প্রথম পানির এত প্রবাহ দেখলাম। গরু-ছাগল সব রয়ে গেছে। জীবনটা বাঁচিয়ে কোনোরকমে দৌড়ে এসেছি। ঘরবাড়ি, গরু-ছাগল সব পানিতে তলিয়ে গেছে।

শমসের আলী নামে এক বানভাসি বলেন, রাতে বাঁধ ভাঙার খবর পেয়ে হাতে যা পেয়েছি তা নিয়ে উঠে এসেছি। চোখের পলকে সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেল।

অপরদিকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নেওয়া বানভাসি এসব মানুষরা অভিযোগ করে বলেন, গতকাল রাত থেকে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিলেও কোনো খাদ্য সহায়তা তো দূরের কথা, প্রশাসনের একজন লোকও এখন পর্যন্ত আমাদের দেখতে আসেনি।

বুড়বুড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল আলীম বলেন, আত্মীয় স্বজনরা সকাল থেকে খাবার নিয়ে দেখতে এসেছেন। প্রশাসনের কেউ এ পর্যন্ত এখানে আসেনি। আমারা শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকটে আছি।

মমিনুল হক নামে একজন বলেন, আমরা যারা গরীব মানুষ আছি, আমাদের আল্লাহ ছাড়া কেউ নেই। পানিতে আমাদের ঘরবাড়ি সব ডুবে গেছে। অথচ প্রশাসনের কেউ সামান্য সহানুভূতিও দেখাতে আসেনি।

এ বিষয়ে বুড়িচং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাহিদা আক্তার বলেন, খোলা আকাশের নিচে কারও আশ্রয় নেওয়ার কথা না। আমরা সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যেতে বলেছিলাম। তবুও যারা খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের তালিকা তৈরি করে প্রয়োজনীয় সব সহায়তা দেওয়া হবে।

অপরদিকে গোমতীর বাঁধ ভাঙার খবরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে স্পিডবোট ও ত্রাণ সহায়তা নিয়ে অনেকে এসেছেন এসব এলাকায়। পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধার করছেন তারা।

নরসিংদীর রায়পুরা থেকে আসা জামাল আহমেদ নামে এক যুবক বলেন, আমরা ১০ জনের একটি টিম এক ট্রাক খাবার সামগ্রী ও দুইটা স্পিড বোট নিয়ে এসেছি। সকাল থেকে অন্তত ৪০ জন মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়েছি। আমাদের এই কার্যক্রম চলমান থাকবে।

অপরদিকে সেনাবাহিনীর পক্ষে থেকে জানানো হয়েছে, বুড়িচংয়ে প্রায় ১৫০ জন পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার করেছেন সেনা সদস্যরা। সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা অব্যাহত আছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার নির্বাহী প্রকৌশলী খান মোহাম্মদ ওয়ালিউজ্জমান বলেন, এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ ফুটের মতো বাঁধ ভেঙে গেছে। পানি বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঁধ ভাঙার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। গোমতীর পানি এখনও বিপৎসীমার ওপরে। বৃহস্পতিবার রাত ১২টায় পানি ছিল ১৩৪ সেন্টিমিটার ওপরে। আজ শুক্রবার সকাল ৬টায় তা কমে গিয়ে বিপদসীমার ১২৯ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। এখন আরও কমেছে।

আরিফ আজগর/এফআরএস