ভারি বর্ষণে লক্ষ্মীপুরের সর্বত্র সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। টানা বৃষ্টিতে ২০-২২ দিন ধরে জেলার কমলনগর ও রামগতি উপজেলার পূর্বাঞ্চলে লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন।

বৃষ্টির কারণে খাল-বিল-ফসলি ক্ষেতসহ মানুষের বসতবাড়িও ডুবে গেছে। কোথাও থেকে পানি সরছে না। এমন পরিস্থিতিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন। পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার চরমটুয়া ও আন্ডারচর ইউনিয়নের বাসিন্দাদের মধ্যেও এর প্রভাব পড়েছে।

বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) সকাল থেকে সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রাম (স্মার্ট ভিলেজ), রামগতি উপজেলার চরবাদাম ও চরপোড়া গাছা ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায় পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার চিত্র। সেসব এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে খালবিল মুক্তকরনসহ অবৈধ বাঁধ অপসারণ করলেই জলাবদ্ধতা রোধ হবে। এ জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের ভুলুয়া নদী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভুলুয়া নদীতে পানি থই থই করছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় কোন পানি দেখা যায় না। বৃষ্টির পানি জমে ভুলয়া এখন পানিতে টইটম্বুর। একইসঙ্গে আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাও ডুবে আছে বৃষ্টির পানিতে। অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁটু পরিমাণ পানি জমে আছে। আবার অনেক বাড়িতে কোমর পরিমাণ পানি। সেখানকার মানুষ উঁচু এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে কেউই সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যাননি।

রামগতির চরবাদাম ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকার পূর্ব পাশে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। যতদূর দেখা যায় সব পানি আর পানি। কবরস্থানও ডুবে আছে। যেখানে প্রায় ৭ ফুট পানি উঠেছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সেখানকার প্রত্যেকটি ঘরের ভেতর ৪-৫ ফুট পানিতে ডুবে আছে। এতে ঘরছাড়া হয়েছে কয়েকশ পরিবার। এর মধ্যে এক বৃদ্ধকে দেখা গেছে গরুর জন্য কলার ভেলায় করে বাড়ি থেকে বেড়ি এলাকায় খড় নিয়ে যাচ্ছেন। পানিবন্দি এসব এলাকায় সাপের ভয়ও আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের চরপোড়াগাছা গ্রামের শেখের কিল্লা এলাকায় গিয়ে শতাধিক বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি দেখা গেছে। এর মধ্যে আবদুল মজিদ ড্রাইভারের বাড়ি কোমর পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে। ওই বাড়ির বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম ও আরিফ হোসেনসহ কয়েকজন তাদের পানিবন্দি হয়ে দুর্দশার কথাগুলো বলছিলেন।

ঝর্ণা বেগম বলেন, একমাস আগ থেকে প্রায় প্রতিদিন চরপোড়াগাছায় বৃষ্টি হয়। এতে ২২ দিন ধরে তাদের বাড়ির উঠানসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমে আছে। গত ৫ দিনের টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনেসহ আশপাশে কোমর পর্যন্ত পানি জমে আছে। একটুও পানি নামছে না। বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি। আমাদের ঘরে আরও পাঁচটি পরিবারকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ইট বসিয়ে রান্না করতে হয়েছে। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানির কারণে আগুন জ্বলছে না। কেউ তাদের খোঁজও নিতে যায়নি।

ওই বাড়ির বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, ২২ দিন ধরে আমরা খুব কষ্টে আছি। চারপাশের পানিতে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চাদের সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে শাহজাহান, ফারুক, কুলসুমা বেগম ও ইমরান হোসেনসহ কয়েকজন জানান, ভুলুয়া নদী বেদখল আর অবৈধ বাঁধের কারণে পানি জমে আশপাশের গ্রামগুলো ডুবে গেছে। এ নদীতে স্রোত থাকলে পানি নেমে যেত। কিন্তু নদীতে স্রোত নেই, জলাবদ্ধতার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে এটি। কয়েকটি স্থানে অবৈধ বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পানির কারণে পুরোপুরি কাটা সম্ভব হয়নি। এছাড়া নদীটির দক্ষিণে চরবাদাম ইউনিয়ন সীমানা শেষ হলেই চরপোড়াগাছা ইউনিয়নে নদী দখল করে ঘর উঠানো হয়েছে ও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বাঁধ কাউকে সরাতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে বহু প্রভাবশালীর বেদখলে থাকায় নদীতে পানি প্রবাহ নেই। নামে নদী হলেও এটি এখন মানুষের জন্য মৃত্যু ফাঁদ। অবৈধ দখলদার ও বাঁধগুলো অপসারণ করলেই এ নদীতে প্রবাহ ফিরে আসবে। জলাবদ্ধতাও নিরসন হবে। এ জন্য তারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে সর্বোচ্চ সহযোগিতা চেয়েছেন।

চরপোড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, আমার ইউনিয়নের আজাদনগরের দক্ষিণে স্টিল ব্রিজ এলাকায় নদী দখল করে কয়েকটি ঘর উঠানো হয়েছে। ঘরগুলোর কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজব্বর ইউনিয়নে নদীটির তিনমুখী একটি এলাকায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। সেইসঙ্গে আমার ইউনিয়নের কোডেক বাজার এলাকায় সম্প্রতি একটি ব্রিজ হয়েছে। এতে ব্রিজের দুই পাঁশে বাঁধ দিতে হয়। কিন্তু বাঁধগুলো পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। এখন তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাঁধগুলো অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয়রা আমার বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন। উপজেলা প্রশাসনের লোকজন এসে দেখে গেছে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি।

তিনি আরও বলেন, প্রায় ২০ দিন ধরেই আমার এলাকার বহু মানুষ পানিবন্দি। অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে লোকমান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ তিনটি সাইক্লোন শেল্টারে অর্ধ-শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদীতে ভাটা এলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সবগুলো স্লুইস গেইট খুলে দেওয়া হয়। আবার জোয়ারের সময় গেইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক আমাদের কর্মীরা পর্যবেক্ষণে আছেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জেলায় জলাবদ্ধতায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি আছেন। বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এছাড়া আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯টি সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত আছে। খালগুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা। এতে পানি নামতে পারছে না। জনগণ আমাদের এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করছেন। প্রশাসনের উপস্থিতি ও জনগণের সহযোগিতায় অবৈধ বাঁধগুলো কেটে দেওয়া হচ্ছে।

এফআরএস