টেকনাফে ক্রসফায়ারের নামে র্যাবের বিতর্কিত কাণ্ড
চুপ থাকতে বলেছিলেন কাদের-কামাল, একরামুল হত্যায় মামলা করবেন স্ত্রী
কক্সবাজারের টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক হত্যাকাণ্ডের ছয় বছর পেরিয়ে গেছে। এখনো এই ঘটনায় মামলা করতে পারেনি পরিবার। দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন মামলা করবেন বলে জানিয়েছেন একরামুলের স্ত্রী।
র্যাব কর্মকর্তারা কাউন্সিলর একরামুলের মৃত্যুকে ক্রসফায়ার বললেও ঘটনার সময় একরামুলের মোবাইল ফোনে তার মেয়েদের করা ‘কল’ চলমান থাকায় এবং পরবর্তীতে ওই ফোন কলের অডিও প্রকাশ পাওয়ায় পরিষ্কার হয়ে যায় এটি ছিল একটি হত্যাকাণ্ড।
বিজ্ঞাপন
নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের পর গণমাধ্যমে কথা বলার ক্ষেত্রে নানামুখী চাপে ছিলেন একরামুলের স্ত্রী ও পরিবারের সদস্যরা। সরকারের প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীও তাদের চুপ থাকতে বলেছিলেন তখন।
তবে এখন পরিস্থিতি বদলেছে। ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বস্তি ফিরেছে একরামুলের পরিবারে। তারা এখন নতুন করে বিচার পাওয়ার আশা করছেন।
রোববার (১৮ আগস্ট) একরামুলের স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট। তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা ও আপত্তিতে এতদিন মামলা করতে পারেননি তারা। তবে এখন মামলা করবেন।
আয়েশা বেগম বলেন, ‘ছয় বছরেরও বেশি সময় কেটেছে। এখনো মামলা করতে পারিনি। বিভিন্ন সময় নানাভাবে আমাকে ভয়ভীতি দেখানো হয়েছে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে বিচার চাওয়ার কথা বলায় সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ফোন করে আমাকে চুপ থাকতে বলেছিলেন। আমি চুপ ছিলাম। তারা আমাকে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সেটি তারা করেননি। হঠাৎ একদিন একটি টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হয়, আমরা নাকি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি! কিন্তু আমরা সেখানে যাইনি, দেখা করার সুযোগও হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘যেদিন আমার স্বামীকে হত্যা করা হয় সেদিন র্যাবকে অনুরোধ করেছি- যা হাওয়ার হয়েছে আমার স্বামীর মরদেহকে আর কষ্ট দেবেন না। দয়া করে ময়নাতদন্ত করবেন না। কিন্তু তারা আমার সে কথাটাও রাখেনি। উল্টো র্যাব আমাকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে দ্রুত সময়ে ময়নাতদন্ত করে। আমি টেকনাফ থানা ও আদালতে এটি নিয়ে মামলা করতে চাই। আইনজীবীরা অজুহাত দেন র্যাব সদস্যরা মামলা নিতে দেননি। এখন আমি মামলায় যাব। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে আলাপ চলছে। তারা মত দিলেই মামলা করব।’
মামলায় ওবায়দুল কাদের ও আসাদুজ্জামান খান কামালকে আসামি করা হবে কি না জানতে চাইলে আয়েশা বেগম বলেন, ‘যদি পারিবারিকভাবে মামলার সিদ্ধান্ত আসে অবশ্যই তাদের আসামি করব।’
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ৪ মে দেশজুড়ে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগানে শুরু হয় মাদকবিরোধী অভিযান। ওই বছরের ২৬ মে রাতে টেকনাফে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় ইয়াবা ব্যবসার।
কিন্তু ঘটনার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে একরামুলের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ ছিল মিথ্যা। ব্যক্তিগতভাবে অভাব-অনটনে ছিলেন এই কাউন্সিলর।
জানা গেছে, বাবার রেখে যাওয়া ৪০ বছরের পুরোনো বাড়ির একটি কক্ষে থাকতেন একরামুল হক। ধারদেনা করে পৈতৃক ভিটায় বাড়ি করার কাজ শুরু করেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে যেদিন সন্ধ্যায় ঘর থেকে বের হন, তখন মোটরসাইকেলে তেল ভরার মতো টাকাও ছিল না তার। বাসার উল্টো দিকের একটি হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে ৫০০ টাকা ধার করে বেরিয়েছিলেন।
একরামুলের স্বজনরা জানান, হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে টেকনাফে গুজব ছড়িয়েছিল একরামুল ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিন একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন অনবরত একরামুলকে বিরক্ত করছিলেন। বারবার বলছিলেন, একরামুল যেন তাদের একখণ্ড জমি কেনায় সহযোগিতা করেন। তাদের চাপাচাপিতে একরামুল বাধ্য হয়ে বাসা থেকে বের হন। কিন্তু জমির বিষয়টা ছিল অজুহাত। তাকে হত্যা করার জন্য ডেকে নিয়ে যাওয়া হয় বলে মনে করেন পরিবারের সদস্যরা।
একরামুলকে হত্যার সময় তার মেয়েদের সঙ্গে চলমান থাকা ফোন কলের অডিওতে শোনা যায়, মৃত্যুর আগে বাবাকে তার মেয়েরা বলছিল ‘বাবা তুমি কাঁদছ কেন?’ এর কিছুক্ষণ পর ফায়ারের আওয়াজ শোনা যায়। এই অডিও শোনার পর দেশব্যাপী র্যাবের বিরুদ্ধে এবং ক্রসফায়ারের বিরুদ্ধে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এ ঘটনার জেরে কিছুদিন পর বন্ধ করে দেওয়া হয় র্যাবের ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ অভিযান।
সাইদুল ফরহাদ/আরএআর