পাবনায় শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করা প্রিন্স-সাঈদ-মিন্টু কোথায়?
পাবনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের হামলায় দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। ওইদিন শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করতে দেখা গেছে আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের। তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক প্রিন্সকেও পিস্তল হাতে গুলি ছুড়তে দেখা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া বিভিন্ন ভিডিওতে। এনিয়ে জেলাজুড়ে নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর থেকেই লাপাত্তা শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু, আব্দুল আহাদ বাবু, পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন, রুহুল আমিনসহ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নেতাকর্মীরা।
বিজ্ঞাপন
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত রোববার (৪ আগস্ট) বেলা ১১টা থেকে পাবনা সরকারি অ্যাডওয়ার্ড কলেজ থেকে বিশাল বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা আব্দুল হামিদ রোডের ট্রাফিক মোড়ে তাদের ঘোষিত কর্মসূচি পালন করছিলেন। এ সময় যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক ও তার লোকজন শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানোর চেষ্টা করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের ধাওয়া দেন। তারা পিছু হটলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা যুবলীগের ওই নেতার অফিস ভাঙচুর করেন। এছাড়া তারা শহরের বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর চালান। এ ঘটনার পর দ্বিতীয় দফায় ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খান ও তার লোকজন সশস্ত্র অবস্থায় হামলা চালান। পরে শিক্ষার্থীরা ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটেন। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা সাঈদের গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করেন। এতে আগুন পাশের একটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
এরপর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান মিন্টু, আব্দুল আহাদ বাবু, পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুন, রুহুল আমিনসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী পিস্তল ও শর্টগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালান। এ ঘটনায় দুইজন শিক্ষার্থীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়। অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ ও শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।
নিহতরা হলেন- শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (১৯), মাহাবুব হোসেন নিলয় (১৬) ও ফাহিম হোসেন রাজ্জাক (১৭)।
এদিকে ঘটনার পর থেকে শিক্ষার্থীদের অবস্থান কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের নেতাদের গুলি করার বেশ কয়েকটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হতে থাকে।
ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে একটি পিস্তল নিয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে শিক্ষার্থীদের মিছিলে ধাওয়া করছেন। তার পাশে অনেকের হাতে শর্টগান, লোহার রড, জিআই পাইপ ছিল।
এছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, পাবনা পৌরসভার সাবেক মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু, জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শিবলী সাদিক, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র শরীফ উদ্দিন প্রধান, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ আল মামুনসহ বেশ কয়েকজন নেতাকে শর্টগান ও পিস্তলসহ দেখা গেছে। সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সোহেল হাসান শাহীন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম পাকন ও সদস্য নজরুল ইসলাম সোহেলের কাছেও অস্ত্র দেখা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই পাবনায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের দেখা যাচ্ছে না। নেতাদের অনেকেই বর্ডার হয়ে ভারতে পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। আবার অনেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন বলেও জানা গেছে। কেউ কেউ পাবনাতেই আত্মগোপনে আছেন।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কয়েকজন নেতাকর্মী বলেন, আসলে এমন একটি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে কখনো ভাবিনি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম ২০৪১ সাল পর্যন্ত আমরা ক্ষমতায় থাকব। হঠাৎ নেত্রীর এমন পদত্যাগে আমরা বিস্মিত হয়েছি। আমরা এখন পুরো এতিম। এতোদিন যাদের কথা মতো দল করেছি, দলের বিভিন্ন বিপদ-আপদে থেকেছি। আজকে পাবনার সেসব নেতারা লাপাত্তা হয়েছেন। সবার ফোন বন্ধ পাচ্ছি। কোথায় গেছেন আমাদের পাবনার নেতারা কেউ বলতে পারব না। আমরা এখন অভিভাবকহীন। বাড়ির বাহিরে বের হতে ভয় পাচ্ছি। সেজন্য কয়েকদিন হলো বাড়ির বাইরে যেতে পারছি না। বাড়িতে থেকেই এলাকার কিছু নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করতেছি। কিন্তু বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের ফোন বন্ধ রয়েছে। গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার নেতাকর্মী বর্তমানে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তবে একদিন সুদিন আসবে বলে মনে করেন তারা।
পাবনা জেলা ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড জাকির হোসেন বলেন, পাবনায় শিক্ষার্থীদের মিছিলে অতর্কিত গুলি করে হত্যা করা হয়েছে সেটা নৃশংসের চেয়েও নৃশংসতা বলতে হবে। এটা বিএনপির আমলেও সন্ত্রাসীদের দিয়ে গুলি করানো হয়েছে। আবার স্কয়ারের পিন্টু চৌধুরীও সন্ত্রাসীদের দিয়ে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীরা কোথায় আছে এটা এখন বাংলার জনগণ সবাই জানে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাবনার অন্যতম সমন্বয়ক রাফিউল ইসলাম রাফি বলেন, আসলে সেদিন যে বিষয়টি হয়েছিল তা খুবই ঘৃণিত কাজ। আমি নিজেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিলাম। এখন একটু সুস্থ হয়েছি। আমরা তো নিরস্ত্র ছিলাম। আমাদের ওপর হামলা করা হয়েছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পাবনার আরেক সমন্বয়ক ফাহাদ হোসেন বলেন, পাবনায় গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ অবস্থান কর্মসূচিতে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা স্থানীয় এমপি থেকে শুরু করে অনেক নেতারা মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করেছে। গুলি করে যারা হত্যা করেছে তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত ফাঁসি কার্যকরের দাবি জানাই।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা পরিষদের পাবনা জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার মো. নাসিম বলেন, ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে যারা নির্বিচারে গুলি করে তারা কোনো সময় দেশপ্রেমিক নাগরিক নয়। তাদের সবাইকে সন্ত্রাসী বলতে হবে। তৃণমূলের কর্মীদের মাঠে নামাতে না পেরে নেতারা অবৈধ অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা ন্যাক্কারজনক কাজ। এটা আওয়ামী লীগের দেউলিয়াত্বের শামিল। গুলি করে এখন তারা পলাতক হয়েছে। এতো সাহস তাহলে পালালেন কেন। এদেরকে ধরে দ্রুত বিচারে ফাঁসি দিতে হবে।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করতে পাবনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। এজন্য তার বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, পাবনার সব থানার কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। স্বাভাবিক হলে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেদিন আমিও সেখানে ডিউটিতে ছিলাম। ভাঁড়ারার সাঈদ চেয়ারম্যান ও তার লোকজন যেভাবে গুলি করে হত্যা করেছে, নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দায়ের করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাকিব হাসনাত/আরএআর