ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। সঙ্গে নিয়ে গেছেন তার ছোট বোন শেখ রেহানাকেও। বিদেশে পাড়ি দিয়ে জনরোষ থেকে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার বাঁচলেও অভাবনীয় মহাবিপদে পড়েছেন তার সরকারে থাকা এমপি-মন্ত্রীসহ দলীয় নেতাকর্মীরা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং চলমান পরিস্থিতিতে প্রাণভয়ে আত্মগোপনে চলে গেছেন নীলফামারীর আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্যরা। পাশাপাশি আত্মগোপনে রয়েছেন দলের পদধারী নেতারাও। অভিভাবকশূন্য সংকটময় এ দিনগুলোতে বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তাদের কর্মী-সমর্থকরা।

সবশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নীলফামারী জেলার সংসদীয় চারটি আসনের তিনটিতেই আধিপত্য ছিল আওয়ামী লীগের। এখানকার নীলফামারী-১ (ডোমার ও ডিমলা) আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন আফতাব উদ্দিন সরকার, নীলফামারী-২ (নীলফামারী সদর) আসনে আসাদুজ্জামান নূর ও নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন পাভেল। আর নীলফামারী-৪ (সৈয়দপুর-কিশোরগঞ্জ) আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন জাতীয় পার্টির জেলা কমিটির সাবেক সদস্য সিদ্দিকুল আলম সিদ্দিক।

নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, নীলফামারী-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আফতাব উদ্দিন সরকারের কোনো খোঁজ মিলছে না। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা তৃতীয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট তাকে ডিমলার বাড়িতে দেখা যায়। পরদিন ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর বিক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে মালামাল লুট করে। বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের আগেই তিনি আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে ধারণা করছেন স্থানীয়রা। অনেকে ধারণা করছেন তিনি লালমনিরহাটের পাটগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে একদিন অবস্থান করে বুড়িমারী স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে চলে গেছেন।

শুধু আফতাবই নয় ডোমার ও ডিমলা উপজেলার আওয়ামী লীগের দলীয় অনেক নেতাই এখন আড়ালে চলে গেছেন। এ দুই উপজেলায় বড় ধরনের কোনো সহিংসতা না ঘটলেও এখন পর্যন্ত ভাঙচুর ঘটেনি। তবে দু-একজনের বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা ও ভাঙচুরের খবর পাওয়া গেছে।

এদিকে নীলফামারী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূরও লাপাত্তা রয়েছেন। তিনি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে টানা পঞ্চমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সবশেষ গত ১৬ জুলাই তিনি নীলফামারীতে আসেন। এরপর ১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীর জানাজায় অংশগ্রহণ করে ঢাকায় ফিরে যান। একটি সূত্র বলছে, সেখান থেকে তিনি লন্ডনে মেয়ের কাছে চলে গেছেন। এদিকে ৪ আগস্ট তার নীলফামারীর বাড়িতে ভাঙচুর ও ৯টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা।

নীলফামারী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন পাভেলও নেই তার এলাকায়। শেখ হাসিনার পলায়নে তিনি এখন কোথায় রয়েছেন জানেন না স্থানীয় নেতারা। তবে একটি সূত্র জানিয়েছে, সাদ্দাম হোসেন পাভেল ঢাকায় রয়েছেন। এদিকে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা সাদ্দাম হোসেন পাভেলকে না পেয়ে তার গাড়ির ড্রাইভারের ওপর হামলা চালিয়েছেন। তার গাড়ির ড্রাইভার শামীম বর্তমানে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, অফিস ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ ঘটায়। শুধু সংসদ সদস্যরাই আত্মগোপন করেছে, এমনটা নয়। নীলফামারী জেলা ও জেলার ছয় উপজেলার আওয়ামী লীগের নেতা এবং অঙ্গসংগঠনের সবাই আত্মগোপনে রয়েছেন। এখন দলীয় নেতাকর্মীদের বেশির ভাগই অবস্থান পরিবর্তন করার পাশাপাশি বন্ধ রেখেছে মুঠোফোন নম্বর। এ কারণে দায়িত্বশীল কারও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

এদিকে আওয়ামী লীগের সংকটময় এই দুর্দিনে তাদের কর্মী-সমর্থকরাও যোগাযোগ করতে পারছেন না নেতাদের সঙ্গে। এতে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তারা। যদিও নীলফামারীতে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মী-সমর্থকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি।

নাম না প্রকাশের শর্তে অনেকেই বলেছেন, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তৃণমূলের কর্মীদের এতদিন যে আস্থা ছিল, তা এখন আর নেই। তাদের কেউই নাকি কল্পনা করতে পারেননি শেখ হাসিনা এভাবে পালিয়ে যাবেন। এমন পরিস্থিতিতে তাদের মনোবল ভেঙে গেছে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা যে এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন সেটাও কেউ কোনোদিন কল্পনা করেনি বলে মনে করছেন।

চলতি বছরে জানুয়ারি মাসে টানা চতুর্থবারের মতো নতুন সরকারের ক্ষমতা নেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থেকেও ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমাধান করতে পারেনি হাসিনা সরকার। একের পর এক বক্তব্য ও ভুল সিদ্ধান্তের ফলে ক্রমেই বেড়েছে আন্দোলনের তীব্রতা। যা সামাল দিতে না পেরে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করেছেন শেখ হাসিনা। গত ৫ আগস্ট দেশ ছাড়ার আগে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেকর্ড করার অনুমতি চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। কিন্তু তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ‘নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে’ পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। দেশ ত্যাগের পরই ক্ষিপ্ত জনতা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করেন। এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। গত ৭ আগস্ট বিকেলে রাষ্ট্রপতির প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

এমজেইউ