নিহত সাজ্জাদ হোসেনের মা ময়না বেগম, স্ত্রী জিতু বেগম ও মেয়ে সিনহা/

গত ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে রংপুর নগরীর সিটি বাজার সংলগ্ন কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে পুলিশ ও আন্দোলনকারীরা মুখোমুখি অবস্থানে ছিল। তাদের মধ্যে কয়েক দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া থেকে একপর্যায়ে সংঘর্ষ বাঁধে। এদিন সিটি বাজারে সবজি কিনতে এসে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ত্রিশ বছর বয়সী সাজ্জাদ হোসেন।

রংপুর নগরীর শিক্ষাঙ্গণ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন কামাল কাছনা রোডে বাড়ি সাজ্জাদের। তার বাবা ইউসুফ আলী চার বছর আগে মারা গেছেন। সাজ্জাদ হোসেন ভ্যানে করে নগরীর আরসিসিআই স্কুল অ্যান্ড কলেজ মোড়ে আদা, রসুন, পেঁয়াজসহ শাক-সবজি বিক্রি করতেন। পাশাপাশি তিনি রাজমিস্ত্রির কাজও করতেন।

সাজ্জাদকে হারিয়ে দিশেহারা তার বিধবা মা, স্ত্রী ও শিশু সন্তানসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। মা-বাবার তিন মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তানের মধ্যে সাজ্জাদ ছিল ভাইদের মধ্যে বড়। সাত বছর আগে বিয়ে করা সাজ্জাদের সংসারে রয়েছে ৫ বছরের একমাত্র সন্তান সিনহা।

এখন সেই শিশুসন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ যেন কথা বলতে পারছেন না। নির্বাক হয়ে আছেন স্বামীকে হারানো স্ত্রী জিতু বেগম। আর সন্তানকে হারানো মা ভাবছেন তার ছেলের স্ত্রী-সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় আচ্ছন্ন পরিবারটিতে এখন সুনসান নীরবতা। শোকে স্তব্ধ প্রতিটি মানুষ সাজ্জাদকে খুঁজতে থাকা শিশুকন্যা সিনহার একটি প্রশ্নের কাছে থমকে যাচ্ছেন বারবার। সিনহার প্রশ্ন ‘বাবা কখন বাড়িতে আসবে?’ কিন্তু এর উত্তর কেউ দিতে পারছেন না।

পরিবারের সদস্যরা বলছেন, রাতে বাবার (সাজ্জাদের) বুকে মাথা রেখে ঘুমাবে বলে অপেক্ষায় জেগে থাকে পাঁচ বছরের ছোট্ট শিশু সিনহা। তার বিশ্বাস বাবা দূরে কোথাও কাজে গেছেন। কয়েক দিন পর বাসায় ফিরে আগের মতো কোলে নিয়ে আদর করে কপালে চুমু দেবেন। দোকান থেকে নাস্তা কিনে দেবেন। হাত ধরে মাদরাসায় নিয়ে যাবেন। সেই আশা নিয়ে গত ১২ দিন ধরে রাত জেগে বাবার অপেক্ষায় থাকে সিনহা। গভীর রাত পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে উঠে আবারও বাবা বাবা বলে ডাক শুরু করে। কিন্তু বাবার দেখা মেলে না। বাড়িতে সবাই আছে শুধু তার বাবা নেই।

অবুঝ সিনহার কাছে তার বাবা কোথায় আছে জানতে চাইলে মলিন মুখে উত্তর দেয়, জানি না।

গতকাল সোমবার (২৯ জুলাই) দুপুরে কামাল কাছনায় সাজ্জাদ হোসেনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িতে ছোট পরিসরে দোয়ার আয়োজনের প্রস্তুতি চলছিল। স্থানীয়দের সহায়তায় এই আয়োজনে সাজ্জাদের বোনেরাসহ সবাই বিষন্ন মনে ঘরের মেঝেতে বসে আছেন। তাদের মধ্যে কেউ ব্যস্ত রান্নার কাজে, কেউ ব্যস্ত শিশু সিনহাকে সামাল দিতে। সবার চিন্তা কীভাবে চলবে সাজ্জাদের পরিবার। কেননা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি না ফেরার দেশে চলে গেছেন, যে কিনা একাই তার মা, এতিম ভাগনি, স্ত্রী ও পাঁচ বছরের মেয়ের অন্ন জোগাতেন।

পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ঘটনার দিন (১৯ জুলাই) শুক্রবার দুপুরে জুমার নামাজ আদায় করেন সাজ্জাদ। বাড়িতে স্ত্রী জিতু বেগম না থাকায় হোটেলে ভাত খান। সাজ্জাদের পরিকল্পনা ছিল পরের দিনের জন্য আদা, রসুন, পেঁয়াজ কিনে বাসায় রেখে সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়ি যাবেন। শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রী-সন্তান কয়েক দিন আগে বেড়াতে গেছেন। তাদের নিয়ে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাবেন সাজ্জাদ। কিন্তু এক গুলিতে সবকিছু শেষ হয়ে গেল। স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে দাওয়াত খাওয়া আর হলো না সাজ্জাদের। লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়িতে।

সাজ্জাদ হোসেনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার প্রথম সংবাদটি আসে তার দুলাভাই আলী হোসেনের ফোনে। এরপর আলী হোসেন সরাসরি সাজ্জাদের মোবাইল ফোনেই কল করেন। অপরপ্রান্তে ফোন ধরতেই সাজ্জাদ, সাজ্জাদ বলে ডাকতে থাকেন আলী হোসেন। তখন বলা হয়, সাজ্জাদ বেঁচে নেই, গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মরদেহ রয়েছে। মরদেহ নিতে হলে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র লাগবে। পরে আলী হোসেন শ্যালকের মৃত্যুর খবর তার মা ও ছোট ভাইকে জানান এবং শ্বশুরবাড়ি যান প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে। এরপর হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে বাসায় ফিরে আসেন। এ ঘটনার পরদিন শনিবার (২০ জুলাই) সকাল ১০টায় জানাজা শেষে সাজ্জাদ হোসেনকে দাফন করা হয়।

স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে সাজ্জাদ 

সাজ্জাদের দুলাভাই আলী হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত ১৯ জুলাই সাজ্জাদ হোসেন বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে কৈলাশরঞ্জন উচ্চ বিদ্যালয়ের গেট দিয়ে সিটি বাজারে যাওয়ার পথে আকস্মিক পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষের মধ্যে আটকা পড়েন। অবস্থা বেগতিক দেখে একপর্যায়ে লুকাতে গিয়ে একটি গুলি এসে তার পেটের বাম পাশে লাগে। গুলিটি পেটের বাম পাশে ঢুকে ডান পাশ দিয়ে হাতের কনুই হয়ে বের হয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, নগরীর আনছারী মোড় এলাকায় সাত বছর আগে সাজ্জাদ বিয়ে করেছেন। তার মেয়ে সিনহা বাড়ির পাশেই একটি মাদরাসায় প্লে শ্রেণিতে পড়ে। স্ত্রী-সন্তান, মা ও এক ভাগনিকে নিয়ে সাজানো ছিল সাজ্জাদের ছোট্ট সংসার। ছোট ভাই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। বোনদের সবার বিয়ে হয়েছে। সাজ্জাদ কখনও রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন আবার কখনো ভ্যানে করে শাক-সবজি বিক্রি করতেন।

নিহত সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার দিন সন্ধ্যায় বাবার বাড়ি থেকে আমাকে নিতে যাওয়ার কথা ছিল। আমাকে নিয়ে রাতে বিয়ের দাওয়াত খেতে যাওয়ার কথা ছিল তার। সাজ্জাদের সঙ্গে শেষ কথা হয় দুপুরের দিকে। সেই সময় কথা হয়েছিল, দুপুরে জুমার নামাজ পড়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে পরের দিনের জন্য সবজি কিনে বাসায় রেখে তাদের নিতে যাবে। এটাই ছিল তার সঙ্গে শেষ কথা।

এসব কথা বলার সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু। ‘কেন বাজার গেল সবজি কিনতে, আর কেনই বা গুলি লাগলো। আমাদের ছেড়ে কই গেলে তুমি, মেয়েকে কী বুঝ দেব, আমার স্বামীতো কোনো রাজনীতি করে না। সে তো কোটামোটা কিছু বুঝে না।’ কান্না করতে করতে বিলাপ করতে থাকেন জিতু।

নিহত সাজ্জাদের স্ত্রী আরও বলেন, এখন কী করে সংসার চলবে। কে মেয়েকে নাস্তা এনে দেবে। মাদরাসার খরচ কে দেবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি চান তিনি।

নিহত সাজ্জাদের মা ময়না বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ছেলে আমার বাজারে গেল ব্যবসার জন্য সবজি কিনতে। বাড়ি ফিরলো লাশ হয়ে। সাজ্জাদের টাকায় আমাদের সংসার চলত। এখন কীভাবে সংসার চলবে জানি না। কয়েক দিন থেকে প্রতিবেশীরা খাবার দিচ্ছে, তাই খেয়ে আছি। এভাবে আর কতদিন চলবে? নাতনিটা সব সময় বাবা বাবা বলে কাঁদে। আমার ছেলে তার মেয়েকে খুব ভালোবাসতো। বাবাকে ছাড়া সে কখনো ঘুমাত না।

এ সময় সাজ্জাদের মা প্রধানমন্ত্রী‌ শেখ হাসিনার কাছে সহায়তা চেয়ে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে আমার নাতনি আর বউমা কিছু করে খেতে পারবে। না হলে না খেয়ে মরতে হবে। তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব চিন্তিত, কী করব কী হবে?

প্রসঙ্গত, গত ১৯ জুলাই রংপুর নগরীর বিভিন্ন এলাকায় কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও দুষ্কৃতকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দফায় দফায় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এদিন সংঘর্ষের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে সাজ্জাদ হোসেনসহ চারজন নিহত হন।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ