দেড় বছরের ছেলে সাঈফকে নিয়ে খুব ভোরে কবর জিয়ারত করতে যান সুমী আক্তার। পাশে দাঁড়ানো ১০ বছরের মেয়ে জান্নতুল। কবরের পাশে দাঁড়াতেই কোল থেকে নিচে নেমে যায় সাঈফ। বাবা বাবা বলতে বলতে এক পা দু পা করে হেঁটে কবরে উঠে যায়। উঠ বাবা উঠ বাবা— বলে বলে মাটিতে ওর কোমল হাত দিয়ে আঘাত করতে থাকে। চোখ ভিজে আসে সুমী আক্তারের। ছেলেকে কোলে টেনে নেন। কিন্তু সাঈফ আবারও কোল বেয়ে নিচে নেমে আসে। ওদিকে সারাক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে জান্নাতুল।

সুমী আক্তার বলেন, সাঈফকে বলেছি এটা ওর বাবার কবর। ও নিজেও দেখেছে ওর বাবার দাফন। এরপর থেকে এদিকে আসলেই ওর বাবাকে ডাকে। বাবা উঠ, বাবা উঠ—অস্পষ্ট হলেও এটাই বুঝায়।

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের বাঁকপুর গ্রামের মাদরাসা সংলগ্ন জসীম উদ্দিনের বাড়ির বৈঠকখানায় কথা হয় জসিম উদ্দিনের স্ত্রী সুমী আক্তারের সঙ্গে। জান্নাতুল ফেরদৌস বড় মেয়ে আর সাঈফ ছোট ছেলে। ছিমছাম এই সংসারটি কায়ক্লেশে চালাতেন জসীম উদ্দিন। তিনি ওই গ্রামের আবদুল মান্নান হাওলাদারের মেজো ছেলে।

পরিবার সূত্রে জানা গেছে, পুরো পরিবার বাড়িতে থাকলেও প্রায় ১৫ বছর ধরে রাজধানীর উত্তরাতে থাকতেন জসীম উদ্দিন। সেখানে ৫ নম্বর সেক্টরের এমএসএ ওয়ার্কশপে ২০ হাজার টাকা বেতনে ম্যানেজার পদে চাকরি করতেন। থাকতেন ওই দোকানের গ্যারেজেই। ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) ৭ নম্বর সেক্টরে ফরহাদ অটো পার্টসের দোকানে যান মাইক্রোবাসের পার্টস কিনতে। সেখান থেকে ফিরেও আসছিলেন দোকানের কাছাকাছি। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া সহিংসতার মধ্যে রাস্তা পার হতে গেলে পুলিশের ছোড়া গুলি বিদ্ধ হন। আন্দোলনকারীরা তাকে উদ্ধার করে নিকটস্থ হাসপাতালে নিলেও ভর্তি নেয়নি হাসপাতাল। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, অনেক আগেই তার মৃত্যু হয়েছে।  

সুমী আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘তার (জসীম উদ্দিন) বুকে বুলেট ঢোকে। সারা শরীরে ছিল শত শত রাবার বুলেটের চিহ্ন। গুলির বীভৎসতা দেখে এলাকার মানুষ কেউ ঠিক থাকতে পারেনি। বিচার আর কার কাছে চাইবো। কার কাছে আমরা নালিশ করব? তারেতো পুলিশ গুলি দিয়ে মারছে। সেতো গ্যাছে—এই বাচ্চা দুইটা কীভাবে মানুষ হইবে, এদের ভবিষ্যৎ কী? আমরা কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না এখন।’

কণ্ঠ ধরে আসছিল সুমী আক্তারের। মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস মায়ের আচল ধরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে। চোখ গড়িয়ে পড়ছে ফোটা ফোটা জল। ১০ দিনেরও বেশি সময় বাবার সঙ্গে কথা হয় না তার। অথচ প্রতিদিন বাড়ির সব বিষয় বাবাকে না জানাতে পারলে স্থীর থাকতো না।

নিহত জসীম উদ্দিনের বোন বলেন, বাড়িতে তরকারি রান্না খারাপ হলেও জান্নাতুল মোবাইল করে বলতো, বাবা রান্না ভালো হয় নাই। আমি খাব না। ওর বাবা ঢাকায় থাকলেও ওর প্রাণ ছিল বাবার কাছে। এখন মেয়েটা দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছে বাবার শোকে। ওর বাবার সঙ্গ কথা বলতে না পেরে যেন বুক ফেটে যাচ্ছে।

জসীম উদ্দিনের বড় ভাই নিজাম উদ্দিন বলেন, পূর্ব সলিয়াবাকপুর দারুল উলুম হোসাইনিয়া কওমি কেরাতিয়া মাদরাসা থেকে পাস করলেও জসীম উদ্দিন কোনো দিন কোনো দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমাদের সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। বাবা ২০২০ সালে মারা গেছেন। মা এখন স্ট্রোকের রোগী। এর মধ্যে ভাইটা মারা যাওয়ায় আমাদের সব কিছু তছনছ হয়ে গেছে।

তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার খবর পেয়ে চট্টগ্রামে থাকা আমার আরেক ভাই সাহাবুদ্দিন এসে হাসপাতাল থেকে মরদেহ নিয়ে বাড়িতে ফেরে। পরদিন শুক্রবার বাবার কবরের পাশে ওকে দাফন করা হয়েছে।

সলিয়াবাকপুর ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ফুয়াদ সরদার বলেন, সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত জসীম উদ্দিনকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন দেওয়া হয়েছে। ওদের পরিবার হতদরিদ্র। জসীম উদ্দিন মারা যাওয়ায় সংসার চালানোর মতো সক্ষমতা থাকল না। সরকারের কাছে অসহায় এই পরিবারটিকে সহায়তা করার অনুরোধ রইল। 

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর