‘আমার বাজানের অনেক কষ্ট হইছে মউতে’
মূল সড়ক থেকে কাদামাখা পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে বাড়ির সীমানায় ঢুকতেই দেখা গেল নতুন একটি কবরের যত্ন নিচ্ছেন ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ। তাকে সাহায্য করছেন ৫০ বছর বয়সী এক নারী। কাজের শব্দ আর ক্ষণে ক্ষণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ হচ্ছিল না। কী করছেন— প্রশ্ন করতেই মুখ তুলে তাকালেন দুজন। এরপর হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়লেন সমস্বরে।
একজনের নাম নজরুল ইসলাম, অপরজন তার স্ত্রী সেলিনা বেগম। দুজনে মিলে ছেলের কবরের যত্ন করছিলেন।
বিজ্ঞাপন
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির ফোঁটা কপাল থেকে মুছতে মুছতে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুক্কুরবার (শুক্রবার) বিয়ালে পোলার মোবাইল থেইক্যা একটা কল আয়। আনুমানিক সন্ধ্যা ৬টার দিকে। আমি নামাজে যামু হেইজন্য রেডি হইতেছিলাম। কল ধরতেই একজন অচেনা মানুষ কথা কইতে লাগলো। আমি কইলাম, ইমরান— কথা হোন (শোন) না? ওদিক দিয়া কইলো, হে ডাক্তার। ইউনাইটেড হাসপাতালের ডাক্তার। ইমরান নাকি খুবই অসুস্থ। শিগগির কাউরে পাঠাইতে কইলো।’
বুক ভর্তি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দম নেন তিনি। আবারো চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আমি পোলার বউরে কল দিয়া কইলাম— শান্তা শিগগির হাসপাতালে যাও। ইমরান ভালো নাই। ইমরানের একটা পোলা ২২ মাসের। তারে নিয়া রাস্তার গ্যাঞ্জামের মধ্যে হাসপাতালে গিয়া শান্তা দ্যাখে আমার বাজানের শইল (শরীর) দিয়া রক্তের নদী বইতাছে। ডাক্তার কইছে, হে মইরা গ্যাছে।’
কথাগুলো বলতে বলতে দম আটকে আসছিল নজরুল ইসলামের। ছেলের কবরের পাশে বসে পড়েন। পাশেই কাঁদছিলেন সেলিনা বেগম। তিনি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেন, ‘আমরা কেউ ভালো নাই বাজান। সরকাররে কইও—হ্যার বুকের জ্বালা মিটলেই হইবে। আমাগো বুকেতো তাফাল (চুল্লি) ধরাই দিছে। আমার পোলারে এক দিক দিয়া গুল্লি দেছে—নাড়িভুড়ি নিয়া আরেক দিক দিয়া বাইর হইয়্যা গ্যাছে। আমার বাজানের অনেক কষ্ট হইছে মউতে (মৃত্যুতে)।
এতক্ষণে প্রতিবেশী আরও কয়েকজন জড়ো হয়ে গেছেন। সত্তর বছরের জালাল সরদার বলেন, ইমরানকে ছোটবেলা থেকেই চিনি। ও মা-বাবা, স্ত্রী-সন্তানকে খুব ভালোবাসতো। সংসার চালাতে খুব পরিশ্রম করতো। এলাকায় নিরীহ ভদ্র ছেলে ছিল। ও কখনো কোনো দলের রাজনীতি করতো না। এভাবে ছেলেটি মারা যাবে ভাবতেও পারিনি।
তার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিহত ইমরান খলিফার ঘরে পৌঁছে দেখা গেল বারান্দায় ভাবলেশহীন বসে আছেন শান্তা আক্তার (২৬)। তিনি নিহত ইমরানের স্ত্রী। কোলে একমাত্র ছেলে ইয়াজ খলিফা। কোটরিভূত চোখে নিষ্পলক তাকিয়ে আছেন দূরে স্বামীর কবরের দিকে। অপ্রয়োজনীয় কিছু আলাপের পর স্বামীর শেষ সময়ের কথা জানতে চাইলেই ডুকরে কেঁদে উঠলেন। কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, ‘ওর আব্বু নাই আজ ১০ দিন। আমার কাছে মনে হয় এই যেন এসে ডাক দেবেন আমাকে। আমিতো তার অপেক্ষায় বসে আছি। সে আমাকে রাতের খাবার রেডি করতে বলে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে বেড় হইলো। এরপরই সব শেষ।’
আরও পড়ুন
শান্তা জানান, ২০২৩ সালের নভেম্বরে ইমরান তাদের ঢাকা নিয়ে যান। শাহজাদপুর খিলবাড়িটেক এলাকায় একটি টিনশেড ঘরে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। ওই এলাকায় ফুটপাতে জুতা বিক্রির ব্যবসা শুরু করেন ইমরান। তিন মাস এই ব্যবসা করলেও তাতে সংসার চলছিল না। শেষে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে দিনমজুরিতে নামেন। আর বিভিন্ন এলাকায় কাজের খোঁজ করতে থাকেন। চেষ্টা করতে করতে চলতি বছরের ৩ জুলাই নিয়োগ পান গুলশান-২ এ চারুলতা অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে।
শান্তা আক্তার বলেন, ‘ঢাকায় খাইয়্যা-না খাইয়্যা ছিলাম। ইমরান কইতো ধৈর্য্য ধরতে—একদিন আমাগো সুদিন আইবো। চাকরিডা পাইয়া কী খুশি হইছিল, কিন্তু প্রথম বেতনডাও খাইয়া যাইতে পারলো না। এট্টু সুখের মুখ দেখলাম, তহন সব সুখ কাইররা নিলো। এই পোলা কেডা দেখবে, মোরে কেডা কইবে—শান্তা আমাগো সুদিন ফিরবে।’
ঘটনার দিনের বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি জানান, শুক্রবার (১৯ জুলাই) ইমরানের অফিস ডিউটি ছিল সকাল ৮টা থেকে। কিন্তু স্ত্রী অসুস্থ থাকায় সকালে অফিসে যায়নি। অফিসে স্ত্রীর অসুস্থতার কথা জানিয়ে সন্ধ্যা ৭টার দিকে যাবে বলে জানান। অফিস থেকেও যাওয়ার চাপ ছিল না। অফিস থেকে জানিয়েছিল, পরিস্থিতি ভালো হলে যেন যায়। কিন্তু দুপুরের খাবারের পর স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে বলে, নতুন চাকরি, কাজে যোগ না দিলে যদি চাকরি চলে যায়? বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে স্ত্রীকে রাতের খাবার তৈরি করতে বলে বাইরের পরিস্থিতি দেখতে যান। সঙ্গে কয়টা টাকাও নিয়ে যান স্ত্রীর ওষুধ কিনে আনার জন্য। এরপর সময় গড়াতে থাকে। সন্ধ্যা ৭টার দিকে শ্বশুর নজরুল ইসলাম শান্তা আক্তারকে মোবাইলে জানান ইমরানের অসুস্থতার কথা।
শান্তা বলেন, পুরো গণ্ডগোলের মধ্যে আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি রক্ত আর রক্ত। কতলোক যে লাশ হয়ে পরে আছে তার হিসেব নেই। এর মধ্যেই খুঁজতে খুঁজতে দেখি আমার ইমরান লাশ হয়ে পড়ে আছে। গুলি এত কাছ থেকে করা হয়েছে যে নাড়িভুড়ি বাইরে বেড়িয়ে এসেছে।
‘আমিতো রাইতের খাওন রেডি কইরা বইসা আছি, ইমরানতো আর আইলো না। আমার সব শ্যাষ কইরা দিয়া গ্যালো। আমরা এখন কেমনে, কী নিয়া বাঁচমু জানি না। স্বাধীন দ্যাশে গুলিতে মরতে হইবে আমরা কেউ জানতাম না।’ বিলাপ করতে করতে থেমে যান শান্তা।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার নলচিড়া ইউনিয়নের কালনা গ্রামের বাসিন্দা ইমরান গত ১৯ জুলাই বিকেলে শাহজাদপুর বাজারে গুলিবিদ্ধ হন। সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে নিকটস্ত ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে রোববার (২১ জুলাই) বিকেলে গৌরনদীর গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয়।
গ্রামের ফরিদ খলিফা বলেন, ইমরানের পরিবার খুবই অসহায়। এখন সে মারা যাওয়ায় ছোট্ট বাচ্চাটা কীভাবে বড় হবে সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তা। ওর বাবা (নজরুল ইসলাম) বয়স্ক মানুষ। তার দ্বারা এখন আর সংসারের রোজগার করা সম্ভব না।
নলচিড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম হাফিজ মৃধা বলেন, ইমরান ঢাকাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। তাকে গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করা হয়েছে। এলাকায় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। ঢাকায় কোনো রাজনীতি করেছে কিনা জানি না।
প্রসঙ্গত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় সারা দেশে ১৪৭ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বরিশাল জেলার বিভিন্ন স্থানে ১৪ জনের দাফন হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। এই ১৪ জনের মধ্যে ইমরান খলিফা একজন।
সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর