‘আমার স্বামী কোনো রাজনীতি করতেন না। তিনি কোনো আন্দোলনে যাননি। তিনি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন, অসুস্থ ছিলেন। তিনি দোকান বন্ধ করে বাসায় ফিরছিলেন। পুলিশের কাছে তিনি হাতজোড় করে কাকুতি-মিনতি করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তারপরও তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমার স্বামীর স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার আর মেয়েকে ব্যাংকার বানাবেন। তার স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমার ছেলেমেয়েকে এখন কে দেখবে?’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কারফিউ চলাকালে ঢাকার সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে মাছবাজার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত মো. কোরবান শেখের  (৪৯) স্ত্রী শিল্পী খাতুন আহাজারি করতে করতে এসব কথা বলেন। নিহত কোরবান শেখ রাজবাড়ীর কালুখালী উপজেলার পূর্ব রতনদিয়া গ্রামের মৃত মেহের শেখের ছেলে।

নিহতের স্বজনরা জানান, দেড় যুগ আগে জীবিকার তাগিদে দুই শিশু সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার সাভারে যান কোরবান শেখ। সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে মাছবাজার এলাকায় তিনি মুরগির দোকান করেন। তার ছেলে রমজান শেখ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে লোক প্রশাসন বিভাগে অনার্স চতুর্থ বর্ষে আর মেয়ে মিতু আক্তার ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ প্রথম বর্ষে পড়েন। স্বপ্ন ছিল ছেলেকে বিসিএস ক্যাডার আর মেয়েকে ব্যাংকার বানিয়ে এরপর গ্রামের বাড়িতে ফিরে ঘর তুলবেন, স্থায়ী বসতি গড়বেন। কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল শারীরিক প্রতিবন্ধী কোরবানের। গ্রামে ফিরলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তাকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন স্ত্রী-সন্তানেরা।

কোরবান শেখের ছেলে রমজান শেখ বলেন, গত ২০ জুলাই সকালে কারফিউয়ের মধ্যেই অনেক দোকানি তাদের দোকান খোলেন। আব্বুও সকাল ৯টার দিকে দোকান খোলেন। আমাদের বাসা থেকে আব্বুর দোকানে হেঁটে যেতে ৫ থেকে ৭ মিনিটের দূরত্ব। দুপুর ১টার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনে আমার বোন আব্বুকে ফোন করে বাসায় চলে আসতে বলে। দুপুর ১টা ৪৭ মিনিটে বাজারের  দোকানি আমার এক চাচা ফোন করে আমাকে জানান যে আমার আব্বুর গুলি লেগেছে। আমি দৌড়ে বাজারে গিয়ে দেখি আমার চাচাসহ কয়েকজন দোকানি আমার আব্বুকে কোলে করে নিয়ে আসছেন। আমরা দ্রুত তাকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে আব্বুকে ভর্তি করেনি। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানকার কর্তব্যরত চিকিৎসক আব্বুকে মৃত ঘোষণা করেন।

তিনি বলেন, পরে আমি জানতে পারি দুপুরে হঠাৎ গোলাগুলির শব্দ শুনে আব্বু দোকান বন্ধ করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। সামনে পুলিশের গুলি করা দেখে আব্বুসহ কয়েকজন দোকানি মাছ বাজারে বরফ কলের গেট আটকে ভেতরে আশ্রয় নেন। পুলিশ বরফ কলের গেট ভেঙে ভেতর ঢুকে তাদের লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে আব্বুসহ সকলেই আহত হন। আব্বুর বুকে ও পায়ে দুটি গুলিবিদ্ধ হয়। এছাড়া বুকে ও মুখে অসংখ্য ছররা গুলি লাগে। পরে আমার আব্বু মারা যান। ওইদিনই রাত ৯টার দিকে আব্বুর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে এনে রাত ১১টার দিকে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।

কোরবান শেখের মেয়ে মিতু আক্তার বলেন, আমার আব্বুর স্বপ্ন ছিল ভাইয়াকে বিসিএস ক্যাডার আর আমাকে ব্যাংকার বানাবেন। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমার আব্বু অসুস্থতা নিয়েও হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আমাদের পড়ালেখা করাচ্ছিলেন। আমার আব্বু শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন, তিনি হাঁটতে পারতেন না। তিনি কোনো আন্দেলনেও যাননি। তাকে দেখে যে কোনো মানুষের মায়া হওয়ার কথা। তারা কীভাবে পারলো আমার অসুস্থ আব্বুকে গুলি করে মারতে? আমার আব্বু পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। সরকারের কাছে আমি আমার আব্বুকে হত্যার বিচার চাই। আর আমার ও ভাইয়ার কর্মসংস্থান চাই।

কোরবান শেখের স্ত্রী শিল্পী খাতুন বলেন, পুলিশ গুলি করার আগে আমার স্বামী হাতজোড় করে কাকুতি-মিনতি করে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিলেন। তারপরও তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়। আমি আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই।

কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেহেদী হাচিনা পারভীন বলেন, কোরবান শেখ আমার ইউনিয়নের বাসিন্দা। সে ঢাকার সাভারে মুদি দোকানের ব্যবসা করতো। কোটা আন্দোলনের সময় গত ২০ জুলাই সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। ২১ জুলাই তাকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে এসে দাফন করা হয়। কোরবান শেখের বাড়িতে আমি নিজে যেতে না পারলেও আমার ইউপি সদস্যদের পাঠিয়ে ছিলাম। আমার জানা মতে কোরবান শেখ কোনো রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না। সে শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে তার দুই সন্তান এতিম হয়ে গেছে।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরএআর