সাড়ে তিন বছরের শিশু মো. মুছাব হাসান এখনো জানে না তার বাবা আর ফিরবে কি না। স্বামী হারিয়ে দিশেহারা স্ত্রী সুলতানা আক্তার। বাবা আবদুল মতিন ও মা ফাতিমা খাতুন উপার্জনক্ষম সন্তান হারিয়ে শোকে মূর্ছা যাচ্ছেন বারবার। সন্তান বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করায় আক্ষেপের শেষ নেই তাদের। এক গুলিতেই শেষ হয়ে যায় ট্রাকচালক মামুনের স্বপ্ন।

মামুন হোসেন (২৮) নোয়াখালী সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের জালিয়াল গ্রামের উল্যাহ ব্যাপারীর বাড়ির আবদুল মতিন ও ফাতিমা খাতুন দম্পতির ছেলে।

জানা গেছে, পেশায় ট্রাক চালক মামুন থাকেন ঢাকায়। গত ১৯ জুলাই বিকেলে ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। আর ওই পথ দিয়ে পার হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি। ২০ জুলাই বিকেলে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মামুনের লাশ দাফন করা হয় ।

মামুনের মা ফাতেমা খাতুন বলেন, আমাদের বাড়িতে ঘরের ভিটা ছাড়া আর কোনো জমি নেই। চার ছেলের তিনজনকে বিয়ে করিয়েছি। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে অনেক কষ্ট করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতিদের নিয়ে থাকতে হয়। আশা ছিল, ছেলে গাড়ি চালিয়ে বাড়তি রোজগার করবে। পরিবারের হাল ধরবে; কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেছে। ছোট্ট নাতির দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। সে কাকে বাবা বলে ডাকবে? আমারও যে বুকটা খালি হয়ে গেলো। আমি বাবা বলে ডাক দিলে যে মামুন আর সাড়া দেবে না।

মামুনের বাবা আবদুল মতিন বলেন, সেদিন ১৯ জুলাই বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মামুন। হঠাৎ একটি গুলি মামুনের পেছন দিয়ে পেটের ডান পাশে ঢুকে। মুহূর্তের মধ্যেই সড়কে লুটিয়ে পড়ে সে । তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল। মামুনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে আসেন আশপাশের পথচারীরা। তারা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।

মামুনের বাবা আরও বলেন, পরে একজন ফোন করে জানলে আমি ছুটে যাই ওই হাসপাতালে। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার পরিস্থিতি তখন এতটাই খারাপ, চিকিৎসা করানোর মতো কোনো অবস্থা ছিল না। পরে মামুনকে নিয়ে যাই মহাখালীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মেলেনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো চিকিৎসককে হাসপাতালে আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। পরে আমার ছেলে বিনা চিকিৎসায় শুক্রবার রাত ৩টায় ওই হাসপাতালে মারা যায়।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে মামুনের স্ত্রী সুলতানা আক্তার বলেন, শেষবার যখন কথা হয়, তখন আমার স্বামী বলেছিলেন যে ঢাকায় অনেক গণ্ডগোল হচ্ছে। তাই তিন দিন ধরে গাড়ি নিয়ে বাইরে বের হতে পারছেন না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার দিন পর বাড়িতে আসবেন; কিন্তু সেই আসা আর হলো না। এর আগেই স্বামীর লাশ দেখতে হয়েছে আমাকে। আমাদের একমাত্র সন্তান মুছাব, তার বাবা যে নেই এটুকু বোঝার বয়সও হয়নি। এ অবস্থায় কী সান্ত্বনা দেব? কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।

হাসিব আল আমিন/এসকেডি