কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় রাজধানীর বনশ্রীতে নিজের ভাড়া বাসার সামনে গুলিতে মারুফ হোসেন (২১) নিহত হয়। তিনি কুষ্টিয়া পলিটেকনিক্যাল কলেজ থেকে শেষবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে ইর্ন্টানি করতে ২০ দিন আগে রাজধানী ঢাকায় এসেছিলেন।

পরে বন্ধুদের সাথে বনশ্রী এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে ওঠেন। গত ১৯ জুলাই দুপুরে তিনি ওই বাসার সামনেই গুলিবিদ্ধ হন। আহত অবস্থায় স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরদিন ২০ জুলাই সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই কুষ্টিয়ার খোকসা কেন্দ্রীয় পৌর ঈদগাহে জানাযা শেষে পৌর কবরস্থানে মারুফকে দাফন করা হয়।

এদিকে ছেলেকে হারিয়ে কান্না থামছে না মা-বাবার। তার মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার অকাল মৃত্যু কেউই মেনে নিতে পারছে না। ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলিতে নিহত মারুফ হোসেন কুষ্টিয়ার খোকসা পৌর এলাকার থানা পাড়ার শরিফ উদ্দিনের একমাত্র ছেলে। তিনি কুষ্টিয়া পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের কম্পিউটার বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

নিহতের বোন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী মাইসা বলেন, সন্ধ্যার পরপরই মাকে ফোন করতো ভাই। আমার সাথেও কথা বলতো। চাকরি পেলেই পছন্দের অনেক খেলনা কিনে দেওয়ার কথা দিয়েছিল। কিন্তু ভাই আর নাই। সন্ধ্যা নামলেই ভাইয়ের ফোনের অপেক্ষায় থাকি। ভাইয়ের কথাগুলো সবসময় কানে বাজে।

নিহত মারুফের বাবা শরিফ উদ্দিন বলেন, গত ১৯ তারিখ সকাল ১১টার দিকে ছেলের সাথে শেষবার কথা হয়। তখনও তাদের মেসে খাবার হয়নি। কথা শেষ হওয়ার আগেই লাইন কেটে যায়। আর কথা হয়নি। বিকেল ৫টার পর ছেলের সহপাঠি নবী ফোন দিয়ে মারুফের মৃত্যুর খবর জানায়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতায় বনশ্রীতে নিজের ভাড়া বাসার সামনে গুলিতে ছেলের মৃত্যু হয়েছে। ছেলের পিঠে দুটি গুলি লেগেছে। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছিলাম। ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। আমার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

এদিকে ছেলেকে হারিয়ে কান্না থামছে না মা-বাবার। একমাত্র ছেলের মৃত্যু সংবাদ পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিলেন মা ময়না খাতুন। এরপর থেকে যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন। কারো কোন প্রশ্নের জবাব দেন না। কেউ কথা বললে শুধু তাকিয়ে থাকেন।

এখন ছেলের থাকার ঘরে স্মৃতি হাতড়ে ফেরেন। নিহত ছেলের ঘরে তালা দিয়ে চাবিটা নিজের কাছে রেখেছেন। ইচ্ছে হলে ওই রুমে গিয়ে টেবিলের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেন। ছেলের ব্যবহারের বাইসাইকেলেটি নেড়েচেড়ে দেখেন মা। মায়ের সাথে ভাইয়ের হাতের স্পর্শ খুজে পাবার চেষ্টা করে একমাত্র ছোট বোন চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী মাইসাও।

নিহত মারুফের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দুই কক্ষের চারচালা টিনের ঘরের বারান্দায় মা ময়না খাতুনকে ঘিরে প্রতিবেশী নারীরা বসে আছেন। ছেলেকে হারানোর শোকে কাদছেন মা ও বোন। তাদের পাশে প্রতিবেশী ও স্বজনরা বসে আছেন। ছেলে হারানোর শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন মা।

মারুফের মৃত্যুতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন পরিবারের সদস্যরা। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেও স্বজন ও স্থানীয়রা ব্যর্থ হচ্ছেন। তারাও কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। নিহতের মা কারো কথায় সাড়া দিচ্ছেন না। হঠাৎ করেই ছেলের ঘরের তালা খুলে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিছুটা সরে গিয়ে ছেলের শোয়ার খাটে বসে বললেন, ‘বাবার সাইকেল। এই সাইকেলেই বাবা (মারুফ) স্কুল করেছে। বাজারে ঘুরতেও যেত।’

খোকসা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আননূর জায়েদ জানান, কোনো অভিযোগ না থাকায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ দাফন সম্পন্ন হয়েছে। এলাকায় অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল।

রাজু আহমেদ/টিএম