‘চার দিন ধরে হাসপাতালের বেডে কষ্টে কাতরাইছে। মৃত্যুর মুখোমুখি হওছে জ্যানেও ছেলের পাশে থাকতে পারিনি। কতই না কষ্ট প্যায়ে মারা গেছে। কতই না আর্তনাদ করিছে। ওরা হামার ছেলের বুকোত গুলি মারলো ক্যা। আল্লাহ হামার ছেলে ফিরাইয়া দাও।’

গতকাল শুক্রবার (২৬ জুলাই) নওগাঁর মান্দা উপজেলার কশব ইউনিয়নের ভোলাগাড়ী গ্রামে গেলে সাংবাদিকদের সামনে কাঁদতে কাঁদতে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন দিনমজুর পিন্টু রহমান। কোটাবিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে সহিংসতার জেরে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডে গুলিবিদ্ধ হয়ে তার ছেলে মো. রাসেল (১৫) নিহত হয়েছে। এরপর থেকেই ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে বার বার মূর্ছা যাচ্ছেন শোকে কাতর বাবা পিন্টু রহমান ও মা অঞ্জনা খাতুন। রাসেলের এমন মৃত্যুতে স্বজন ও প্রতিবেশীরাও শোকাহত।

পিন্টু রহমান বলেন, ছেলের সঙ্গে সর্বশেষ গত শুক্রবার (১৯ জুলাই) বিকেলে মুঠোফোনে কথা হয়েছিল। ওইদিন মা ও বোনের খোঁজখবর নিয়েছে। এরপর হঠাৎ রাত সাড়ে ৮টার দিকে ছেলের নম্বর থেকে এক ব্যক্তি কল করে জানায় রাসেল গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এরপর ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিলেও কারফিউয়ের কারণে আর যেতে পারিনি। 

পিন্টু রহমান ও অঞ্জনা খাতুন দম্পতির চার সন্তান। তাদের পরিবারে চার ভাই-বোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। এদের মধ্যে এক বোন মানসিক প্রতিবন্ধী। বাঁশ-খড়ের বেড়া আর টিনের ছাউনির ছোট্ট একটি ঘরে তাদের বসবাস। সংসারের অভাব অনটনের কারণে প্রাথমিকের গণ্ডি না পেরোতেই পড়াশোনা থেমে যায় রাসেলের। দেড় বছর যাবত নারায়ণগঞ্জের একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে ৬-৭ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে আসছিল সে। গত কোরবানি ঈদের ছুটিতে বাসায় এসে পরিবারের সঙ্গে ঈদ করে আবারো নারায়ণগঞ্জে ফিরে যায় রাসেল।

১৯ জুলাই বিকেলে নারায়ণগঞ্জের ডিআইটি রোডের দেওভোগ মার্কেটের ২ নম্বর গেটের সামনে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের। সেখানে গুলিবিদ্ধ হয় কিশোর রাসেল। এরপর আহত রাসেলকে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে। ২১ জুলাই তার বুকে অস্ত্রোপচার করে একটি গুলি অপসারণ করেন চিকিৎসকরা। এর একদিন পর ২২ জুলাই ঢামেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাসেলের মৃত্যু হয়। ২৩ জুলাই দুপুরে রাসেলের মরদেহ পৌঁছায় নওগাঁয়। ওই দিনই গ্রামের বাড়িতে মরদেহ দাফন করা হয়। 

রাসেলের চাচা আবদুর রশিদ বলেন, দেড় বছর ধরে পোশাক কারখানায় কাজ করছিল রাসেল। ৬-৭ হাজার টাকা বেতনে কোনোমতে তাদের সংসার চলছিল। আর কিছুদিন গেলে হয়তো ভালোভাবে কাজ শিখতে পারতো। বেতন বাড়লে পরিবারের পাশে দাঁড়াতে পারতো রাসেল। এখন সব এলোমেলো হয়ে গেল। সন্তানের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবার পাওয়ার পর থেকেই রাসেলের মা খাবার মুখে নিচ্ছে না। ছেলের মৃত্যুর শোকে তার মা-বাবা দুজনই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

নিহত রাসেলের প্রতিবেশী ও কশব ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য পাঞ্জব আলী বলেন, দিনমজুরি করে কোনো রকমে সংসার চালান রাসেলের বাবা। তিন মেয়ের মধ্যে একজন প্রতিবন্ধী। অন্য দুই মেয়ের মধ্যে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের কিছু দিন পরই স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এখন তিনি বাবার সংসারেই থাকেন। রাসেলের ওপর নির্ভরশীল হওয়ার আগেই ছেলেটিকে হারাল তার পরিবার। পরিবারটিকে আর্থিক সহায়তা দিতে সরকারসহ বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

আরমান হোসেন রুমন/আরএআর