সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে রাজা সীতারাম রায়ের স্মৃতি বহন করা পৌনে চারশ বছরে পুরোনো রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নে অবস্থিত নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দির। যে জোড় বাংলা মন্দিরকে ঘিরে এক সময় গড়ে উঠেছিল আটটি মন্দির, সেই মন্দির আজ অবৈধ দখলদার ও সংস্কারের অভাবে হারিয়েছে জৌলুস।

জানা যায়, ১৬৫৫ সালে উড়িষ্যার গৌরীয় রীতিতে রাজা সীতারাম রায় এই জোড় বাংলা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে শ্রী কৃঞ্চ রাম চক্রবর্তী রাজা সীতারাম রায়ের অনুরোধে নলিয়া গ্রামে এসে দেব মন্দির এবং বিগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির পাশাপাশি অবস্থিত দুটি মন্দির। একটি মন্দিরের চূড়া থাকলেও অপরটির চূড়া অবশিষ্ট নেই। এই জোড় বাংলা মন্দিরকে ঘিরেই এখানে এক সময় নির্মিত হয় ৮টি মন্দির।

তবে জনশ্রুতি রয়েছে, ১৬৫৫ সালে রাজা সীতারাম রায় তৎকালীন সময়ে রাজবাড়ীর বেলগাছিতে সোনা দিয়ে নির্মিত একটি মূর্তি দিয়ে পূজা করতে চেয়েছিলেন। রাজার ইচ্ছাপূরণে সে সময়ে সোনা দিয়ে মূর্তি তৈরির কাজটি নলিয়া গ্রামের জনৈক এক কর্মকারকে দিয়ে করানোর নির্দেশ দেন। কর্মকার মূর্তি তৈরির জন্য রাজার কাছে সোনা চাইলে রাজা বিষয়টি সন্দেহের চোখে দেখেন। কর্মকার স্বর্ণ চুরি করতে পারে ভেবে রাজা তার নিজ বাড়িতে কর্মকারকে ডেকে সেখানে মূর্তি তৈরি করতে বলেন। রাজার এমন মনোভাবে কষ্ট পান কর্মকার। তিনি রাজার বাড়িতে বসেই সোনার মূর্তির পাশাপাশি অনুরূপ আরেকটি মূর্তি তৈরি করেন পিতলের।

কিন্তু সনাতন ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী একই মন্দিরে দুই পূজা না করার বিধান থাকায় কর্মকার পূজা শুরুর আগে রাজার অনুমতিক্রমে সোনা ও পিতলের তৈরি দুটি মূর্তির কথা স্বীকার করেন। কোন উপায়ন্তর না পেয়ে তখন রাজা পিতলের তৈরি মূর্তিটি নিয়ে কর্মকারের বাড়ি নলিয়াতে স্থাপন করে সেখানে পূজা করার নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে রাজা সেখানে একটি মন্দিরও নির্মাণ করে দেন। তখন থেকেই এর নাম হয় নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির। এরপর সেখানে রাজা আরো ৮টি মন্দির স্থাপন করে দেন।কালের আর্বতনে আজ ঐতিহ্যবাহী এই নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটি অবহেলা আর অযত্নে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, মন্দিরটি লতাপাতায় ভরে রয়েছে। মন্দিরের গায়ের থেকে ইট খুলে পড়ছে। মন্দিরের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। মন্দিরটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে দীর্ঘদিন কোনো সংস্কার হয়নি। সংস্কারের অভাবে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে শত শত বছরে ইতিহাসের সাক্ষী এই জোড় বাংলা মন্দিরটি। মন্দিরটির ৩১ শতাংশ জমি রয়েছে। সেই জমির বেশিরভাগই এখন বেদখলে বলে দাবি মন্দির কর্তৃপক্ষের। মন্দিরটির অবস্থা খুবই শোচনীয়। মন্দিরের ভেতরে বাস করছে চামচিকাসহ বিভিন্ন প্রাণী।

মন্দিরটির দ্রুত সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের দাবি জানিয়ে মন্দির দেখতে আসা দর্শনার্থী রাজবাড়ী শহরের বাসিন্দা সুজন কুমার বিষ্ণু বলেন, জামালপুর এলাকায় আসলেই এ মন্দিরটি একবার হলেও দেখতে আসি। এই মন্দিরটি আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী।আমাদের রাজবাড়ী জেলা রাজা সূর্য কুমারের নামানুসারে হলেও সংরক্ষণের অভাবে এই জেলায় রাজার কোনো স্মৃতি নেই। তাই আমরা চাই জেলার প্রতিটি পুরোনো স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করা হোক। দ্রুত সংস্কার করে জোড় বাংলা মন্দিরটিকে রক্ষা করা হোক।

মন্দিরের সেবায়েত বিদ্যৎ কুমার মূখার্জী বলেন, ইতিহাসের সাক্ষী এই মন্দিরটি দেখতে প্রতিদিন বিভিন্ন জায়গা থেকে দর্শনার্থী ছুটে আসেন। এখানে আসার পর মন্দিরটির এই করুণ দশা দেখে তারা নিরাশ হয়ে ফিরে যান। অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ঐতিহ্যবাহী নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটি দ্রুত সংস্কার না করলে অচিরেই মন্দিরটি তার অস্তিত্ব হারাবে। 

জামালপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম ফরিদ হোসেন বাবু বলেন, বালিয়াকান্দিতে হাতেগোনা কয়েকটি ইতিহাস-ঐতিহ্যবহনকারী স্থাপনা রয়েছে। তার মধ্যে নলিয়া জোড় বাংলা মন্দিরটি অন্যতম। মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য তার পরিষদের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার প্রত্নতত্ত্ব দপ্তরকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তারা এসে পরিদর্শন করেই শুধু চলে যান। কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না। 

মন্দিরটির সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ঢাকা ও ময়মনসিংহ বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক আফরোজা খান মিতা বলেন, চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝিতে চার সদস্যের একটি দল মন্দিরটি পরিদর্শন করেছে। মন্দিরটি এখনো সংরক্ষিত হয়নি। সংরক্ষণের কাজ চলমান। সংরক্ষণ হওয়ার পরই শত বছরের ঐতিহ্যবাহী নলিয়ার জোড় বাংলা মন্দিরটির সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের উন্নয়নমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরকে