অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী বৃষ্টি। তার ভাই ফয়সাল আহমেদ শান্ত ছিলেন অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। দুজনে সারাদিন বাসা মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু এখন নির্জীব। পড়ার টেবিল, ব্যবহারের দ্রব্য আর পোশাক থরে থরে সাজানো আছে আগের মতই। শুধু ফয়সাল আহমেদ শান্ত নেই। এ কথা এখনো মানতে পারছে না ছোট বোন বৃষ্টি। ভাইয়ের সঙ্গে আগে যেখানে খুনসুঁটিতে বেলা কেটে যেত এখন সারাক্ষণ চুপ করে বসে থাকে সে। কেউ কথা বলতে আসলেই অঝোরে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

‘আমার ভাইয়ারে ফিরায়ে দাও। আমার ভাইয়া কই— আমি ভাইয়ার কাছে যাব। আমার ভাইয়া আর আইবে না।’

স্বজনরা বৃষ্টিকে যতই বোঝান শান্ত আর ফিরবে না, কিছুতেই মানতে চায় না সে। কাঁদতে কাঁদতে মূর্ছা যায়। যতক্ষণ সজাগ থাকে ততক্ষণ ভাইয়ের জন্য কান্না আর বিলাপ করে। ফয়সাল আহমেদ শান্ত নিহত হওয়ার ১০ দিন পরও এমন অবস্থায় বৃষ্টিকেকে নিয়ে উদ্বেগে আছে স্বজন ও পরিবার।

বৃষ্টির স্বজন আলাউদ্দিন বলেন, শান্ত নিহত হওয়ার পরে পুরো পরিবার মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। এর মধ্যে শান্তর ছোটবোন বৃষ্টির মানসিক বিপর্যয় খুব বেশি। ও ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। তার ভাই ফিরবে না এটা মানতেই পারছে না।

ফয়সাল আহমেদ শান্তর বাবা জাকির হোসেন বলেন, অত্যন্ত নম্র ছিল আমার ছেলে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি টাকা সে কখনোই নিত না। কয়েকটি টিউশনি করাতো হাত খরচার জন্য। ওতো কোনো মিছিলে যায়নি। ও রওয়ানা করেছিল টিউশনি করাতে। পথিমধ্যে গুলিতে মারা গেল আমার বাজান। আমি জাকির হোসেন শহীদ ফয়সালের গর্বিত পিতা— এইটাই আমার পরিচয়। আমি শহীদের পিতা।

কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, আমার তরতাজা ছেলেটার বুকে গুলি করে ঝাঁজরা করে দিয়েছে। নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। এখন নানা বাড়ির কবরস্থানে চির ঘুমে। বিচার কার কাছে চাইবো? বিচার করার মানুষ নাই। আল্লাহর কাছে বলি, বিনা দোষে আমার সন্তানকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার যেন আমি জীবদ্দশায় দেখে মরতে পারি।

ফয়সাল আহমেদ শান্তর মা স্কুলশিক্ষিকা রেশমা আক্তার বলেন, আমার ছেলেটাকে গুলি দিয়ে ঝাঁজরা করে দিল। যেদিন লাশ নিয়া আসছি তার সামনে পেছনে পুলিশের গাড়ি। জীবিত অবস্থায় আমার ছেলেকে কেউ নিরাপত্তা দেয়নি। আমার একটাই ছেলে। আশা-ভরসা সবই ছেলেকে ঘিরে ছিল। মঙ্গলবার আমাকে বলে বেড় হয়েছিল আম্মু নাশতা রেডি করো আমি আসতেছি। আমিতো নাশতা রেডি করে বসেছিলাম। আমার ছেলে আর আসলো না। যখন আসলো তখন ছেলে কথা বলে না। লাশ আসলো।

প্রসঙ্গত, ফয়সাল আহমেদ শান্ত চট্টগ্রামের ওমরগনি এমইসি কলেজের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। এর আগে চট্টগ্রামের বাকলিয়া সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। শান্তর মূল বাড়ি বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রহমতপুর ইউনিয়নের মহিষাদী গ্রামে। জন্ম থেকে ওই গ্রামের নানা বাড়িতে বড় হয়েছে। বাবা জাকির হোসেন আগে চট্টগ্রামের জাহাজে চাকরি করলেও করোনাকালে রহমতপুরে ফার্নিচারের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকে শান্ত, বৃষ্টি ও তাদের মা চট্টগ্রামে ভাড়া বাসায় থাকতো। জাকির হোসেন থাকতেন বাবুগঞ্জে। 

গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি, দুই নম্বর গেট ও মুরাদপুর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। দুই ঘণ্টা ধরে চলে সংঘর্ষ। ওই সময় মুরাদপুর দুই নম্বর গেটের মাঝামাঝি জায়গায় গুলিবিদ্ধ হন শান্ত। পরিবারের পক্ষ থেকে টিউশনিতে যাওয়ার কথা বলা হলেও শান্তকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা মিসকাত সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, তাদের সাথেই আন্দোলনে থাকা অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হন শান্ত।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/আরএআর