দুই পা নেই। তবুও থেমে থাকেনি জীবন। প্রবল আত্মবিশ্বাস ও চরম সাহসিকতাই যে জীবনকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে পারে তারই উজ্জ্বল দৃষ্টাস্ত দুই পা হারা মোছা. সোনিয়া আক্তার। মায়ের কোলে চড়ে স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে অনার্সে লেখাপড়া করছেন তিনি। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার ৮ নম্বর রাজীবপুর ইউনিয়নের উজান চরনওপাড়া গ্রামে।

 জানা গেছে, রাজীবপুর ইউনিয়নের উজান চরনওপাড়া গ্রামের কৃষক মো. রইছ উদ্দিননের চার মেয়ে ও দুই ছেলে সন্তানের মধ্যে সোনিয়া আক্তার তৃতীয়। ছোটবেলায় সাধারণ শিশুদের মতই হৈ-হুল্লোড় আর খেলাধুলায় মেতে থাকত সোনিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় হঠাৎ তার পায়ে ব্যথা অনুভব হয়। হাসপাতালে নিয়ে গেলে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জীবন বাঁচাতে সোনিয়ার দুই পা কেটে ফেলে দেন। এরপর থেকেই সোনিয়ার বন্দি হয়ে পড়েন মায়ের কোলে। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি। মায়ের কোলে চড়ে স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করেন। এভাবেই স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে সোনিয়া এখন লেখাপড়া করছেন ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজে। ব্যবস্থাপনা বিভাগে স্নাতকে পড়ছেন তিনি। এতে খুশি তার পরিবার, কলেজের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠীরা। 

সোনিয়া ২০২০ সালে উচাখিলা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে জিপিএ-৩.২২  পেয়ে এসএসসি এবং ২০২২ সালে আলীনগর কারিগরি বাণিজ্যিক কলেজ থেকে  জিপিএ-৪.৯৬ পেয়ে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজে অনার্সে ভর্তি হন। 

প্রতিবেশীরা বলেন, সোনিয়া আমাদের সমাজে দৃষ্টান্ত। ছোটবেলা থেকেই সে মায়ের কোলে চড়ে লেখাপড়া করছে। বাড়িতে চলাফেরা করে কাঠের তৈরি দুই পিড়িতে ভর করে। বাড়ির বাইরে যেতে হলে মায়ের কোল তার একমাত্র ভরসা। এমন নজির বিরল। আমরা চাই তার স্বপ্ন পূরণ হোক, রাষ্ট্রের কর্তারা এগিয়ে আসুক তার জন্য। 

সোনিয়ার মা শিউলী খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার মেয়ে অন্য শিশুদের মতোই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতার কারণে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় তার পা দুটি হঠাৎ কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সেই থেকেই আমি আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে স্কুলে যাওয়া আসা করছি। এ সবই হয়েছে মেয়ের ইচ্ছার কারণে, আমি মা হিসেবে তার ইচ্ছা পূরণে চেষ্টা করেছি মাত্র।

সোনিয়া আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক কষ্ট করে মা কোলে করে আমাকে লেখাপড়া করিয়েছে। আমি মা-বাবার কাছে চিরঋণী। কলেজের স্যার এবং সহপাঠীরা আমার প্রতি অনেক আন্তরিক। তারা সব সময় আমার খোঁজ রাখে। লেখাপড়া শেষ করে আমি সরকারি চাকরি করতে চাই, বাবা-মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। কিন্তু আমার সামনে দিয়ে যখন অন্য ছেলেমেয়েরা নিজের পায়ে হেঁটে খেলাধুলা করে তথন আমার নিজেকে বড় অসহায় মনে হয়। খুব খারাপ লাগে তখন।

ঈশ্বরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. রফিকুল ইসলাম খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়েটির দুই পা নেই। তবুও তার লেখাপড়ার অদম্য ইচ্ছা। আমরা তার এই আগ্রহকে স্বাগত জানাই। সে নারী জাগরণের প্রতীক হতে পারে সে।
তার জন্য আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা সব সময় অব্যাহত থাকবে।

বাবা রইছ উদ্দিন বলেন, আমি যতদিন আছি মেয়ের জন্য চেষ্টা করে যাব। যদি আল্লাহ তার একটা গতি করে। আমি চাই আমার মেয়ের একটি সরকারি চাকরি হোক। সে যেন তার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অদম্য সোনিয়ার পাশে থাকার আশ্বাস দিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সারমিনা সাত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অদম্য সোনিয়া হার না মানার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তার দুটি পা নেই। তার তো থেমে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার মা সংগ্রাম করে তাকে কোলে করে স্কুল-কলেজে পড়িয়েছে এবং সে এখন অনার্সে লেখাপড়া করছে। আমাদের সমাজের হতাশ হয়ে, ব্যর্থ হয়ে জীবনের অর্ধেক পথে থেমে যাওয়াদের জন্য সোনিয়া একটা মেসেজ। দুই পা না থাকা সত্ত্বেও সে যেভাবে জীবন যুদ্ধে শত প্রতিকূলতাকে পার করে সামনে এগিয়ে চলছে, এটা সমাজের হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর জন্য একটা মেসেজ। ধাক্কা খেলেই, হোঁচট খেলেই বা ব্যর্থ হলেই পড়ে যাওয়া নয় বরং দ্বিগুণ উদ্যোমে ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনকে জয় করা। আমি সোনিয়াকে এভাবেই দেখি।  

অদম্য সোনিয়ার পাশে বিত্তবানদের দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়ে সদ্য নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মো. বদরুল আলম প্রদীপ বলেন, সোনিয়াকে দেখে আমাদের শিক্ষা নেওয়া উচিত। ইচ্ছা শক্তি থাকলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। এটা আমাদের জন্য দৃষ্টান্ত।

আরএআর