‘আমার ছেলে আলমগীর খুব ভালো এবং নামাজি ছিল। গুলি খেয়ে গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিল। সেখানে থাকা সহকর্মীরা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলেও সেখানে চিকিৎসা করা হয়নি। বিনা চিকিৎসায় আমার ছেলেটা মরে গেছে। হেলিকপ্টার থেকে তিনটি গুলি করে ছেলেকে মারে ফেলেছে। আমার বেটাতো আর ফিরে আসবে না। এখন ওর বউ ছোয়ালপালের দেখবি কিডা? বাড়ি ছাড়া জাগা জমি বলতে কিচ্ছু নাই। কীভাবে চলবে ওর সংসার? সরকার যদি একটু দেখতে তবেগা বাঁচতাম।’

কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় ছেলেকে হারানোর শোকে কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন নিহত আলমগীর শেখের মা আলেয়া খাতুন। ছেলেকে হারিয়ে মায়ের কান্না যেন থামছে না। আলমগীর কুমারখালীর উপজেলার শিলাইদহ ইউনিয়নের কসবা গ্রামের মুদি দোকানি ইজারুল হকের ছেলে।

সংসারের হাল ধরতে জীবিকার তাগিদে প্রায় ২০ বছর আগে রাজধানী ঢাকায় যান কুষ্টিয়ার মটর গাড়িচালক আলমগীর শেখ। গত ৮ বছর ধরে ঢাকার রামপুরা এলাকায় হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের গাড়ির চালক ছিলেন। এতে যা বেতন পেতেন তা দিয়ে ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, বাসা ভাড়াসহ সংসার চালাতে রিতিমত হিমশিম খেতে হতো গাড়িচালক আলমগীরকে। সেজন্য তিনি সময় পেলে ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালাতেন।

গত ১৯ জুলাই বিকেলে কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রামপুরায় বিটিভি ভবন এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন গাড়িচালক আলমগীর শেখ। ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার গুলিবিদ্ধ মরদেহটি গত রোববার (২১ জুলাই) গ্রামের বাড়িতে নিজ গ্রামের কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। 

নিহত আলমগীর শেখের স্ত্রী রিমা খাতুন বলেন, চাকরির টাকায় সংসার চলতো না। সেজন্য ও (স্বামী) অবসরে পাঠাও অ্যাপে মোটরসাইকেল চালাতো। এখনতো সব শ্যাষ। শ্বশুর, শাশুড়ি, ছেলে, মেয়ে নিয়ে কী করে খাব? কোম্পানি ও সরকারের কাছে সহযোগিতা কামনা করেন তিনি। 

আলমগীর শেখ পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড়। ময়নাতদন্ত ছাড়াই গত শনিবার (২০ জুলাই) গভীর রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়িতে লাশ পৌঁছে দেয় হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের লোকজন। আর রোববার সকালে কসবা দাড়িগ্রাম সামাজিক কবরস্থানে মরদেহটি দাফন করা হয়। পরিবারে তার বাবাসহ বয়োজ্যেষ্ঠ মা আলেয়া খাতুন, স্ত্রী রিমা খাতুন (৩০), মেয়ে তুলি খাতুন (১১), ছেলে আব্দুল আওলাদ (৭) ও ছোট ভাই আজাদ হক (১৮) রয়েছেন।

নিহতের পরিবার ও স্বজনরা জানান, ১৯ জুলাই জুমার নামাজ শেষে স্ত্রীকে রান্নার কথা বলে রামপুরা এলাকায় নিজ কর্মস্থলের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন আলমগীর। সেদিন হেলিকপ্টার থেকে আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যে গুলি ছুড়ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া তিনটি গুলি এসে লাগে আলমগীরের শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। এতে তিনি আহত হন। 

আহত আলমগীরকে ঢাকার একটি হাসপাতালে নিয়ে যান তার কোম্পানির সহকর্মীরা। তবে চলমান পরিস্থিতিতে সেদিন হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক ছিলো না। ফলে সেখানেই তার মৃত্যু হয়। পর হাসপাতাল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স করে মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পাঠানো হয়। স্বজনরা সামাজিকভাবে মরদেহটি দাফন করেন। 

অপরদিকে ঘটনার প্রায় সপ্তাহখানেক পার হলেও কান্না থামেনি সন্তানহারা মায়ের। বাড়িতে কেউ আসলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন তিনি। আলমগীরকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন তার স্ত্রী-সন্তানরা। শুক্রবার (২৬) জুলাই সকালে সরেজমিন তাদের বাড়িতে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।

আলমগীরের ছোট ভাই আজাদ হক জানান, বন্ধুরা ভাইকে হাসপাতালে নিলেও ডাক্তার ছিল না। চিকিৎসা পায়নি। শরীর থেকে গুলিও বের করা হয়নি। গুলিসহ ভাইকে কবর দেওয়া হয়েছে।

বাবা ইজারুল হক বলেন, আমি বুড়ো মানুষ। বড় ছেলেই ছিল সকলের ভরসা। ঘরের সঙ্গে ছোট দোকানে তেমন বেচাকেনা হয় না। খুব দুশ্চিন্তায় আছি পরিবার নিয়ে। আর ছেলে হত্যার বিচার কার কাছে চাইবো।

কুমারখালী থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকিবুল ইসলাম বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সহিংসতায় কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার চারজন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হয়েছেন। নিহতদের মরদেহ নিজ নিজ গ্রামে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণমাধ্যম ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কয়েকটি ঘটনা শুনেছি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করা হলে সরকারিভাবে তাদের সহযোগিতা করা হবে। নিহতের পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছি। সরকারিভাবে কোনো নির্দেশনা আসলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

রাজু আহমেদ/আরএআর