নরসিংদী জেলা কারাগারের মূল ফটক ভেঙে, ভবন পুড়িয়ে দিয়ে ৮২৬ বন্দি পালানোর ঘটনার চারদিন পর সেখানে এখন শুধুই পোড়া গন্ধ। সেদিনের সেই হামলায় নরসিংদী কারাগার শুধু পুড়ে ছাই হয়নি, অস্ত্রাগার থেকে ৮৫টি অস্ত্র ও ৮ হাজার গুলি লুট করেছে দুর্বৃত্তরা। 

হামলায় কারাগারের অফিসকক্ষ, অস্ত্রাগার, বন্দিশালা, ব্যারাক, অফিসারদের বাসাবাড়ি, গ্যারেজে থাকা গাড়ি, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন ভবনে ভাঙচুর ও আগুন দেয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক লাগোয়া কারাগারের নিরাপত্তা প্রাচীরের প্রধান ফটকের সামনের ক্যান্টিনটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তার ভেতরে অবশিষ্ট বলতে কিছু নেই। প্রধান ফটকের সামনে স্থানীয়দের ভিড়। কোনো নিরাপত্তাকর্মী না থাকায় কেউ কেউ ফটক টপকে ভেতরে প্রবেশ করছেন। প্রধান ফটকের পাশেই রেশন গুদামে তখনো জ্বলছিল আগুন।

অনেকে সেখান থেকে চালের বস্তাসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ অনুরোধ করেও তাদের রুখতে পারেননি। সেখানে চারদিকে শুধুই পোড়া গন্ধ। কারারক্ষীদের ব্যারাকের সামনে পড়ে থাকতে দেখা গেছে কয়েকটি পোড়া মোটরসাইকেলের কঙ্কাল। ব্যারাকটিও পুড়ে ছাই। তার একটু সামনেই গ্যারেজে জেল সুপারের গাড়ি ও একটি মোটরসাইকেলের পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। 

ওই দিন সকাল সোয়া ৯টার দিকে উৎসুক জনতা জোর করেই প্রধান ফটক ঠেলে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া কারাগারটিতে প্রবেশ করেন। ওই সময় দেখা গেছে, কারাগারের প্রধান ফটকের কয়েকটি স্থানে কোপের আঘাতের চিহ্ন। তবে ছিটকিনি ছিল অক্ষত।

ছিটকিনি আটকানোর দুটি আংটার মধ্যে একটি ছিল অক্ষত, অন্যটি অর্ধেক উপড়ানো। সামনে এগোতেই দেখা যায়, উত্তর পাশে জেলারের কক্ষে তখনো আগুন জ্বলছিল। কক্ষটির সব আসবাব ভেঙে ফেলা হয়েছে। লণ্ডভণ্ড করা হয়েছে বইপত্র ও বিভিন্ন কাগজপত্র। দক্ষিণ পাশে অস্ত্রাগারটি পুড়ে ছাই। সেখানকার দেয়ালের সব পলেস্তারা খসে পড়েছে।

জেলখানার দ্বিতীয় ফটকটিও তখন খোলা অবস্থায় ছিল। ভেতরে প্রবেশ করতেই কেস টেবিলের ছোট কক্ষ। সেখানে রাখা হতো আসামিদের রেজিস্টার ও নথিপত্র। তবে দুর্বৃত্তদের হামলায় কক্ষটি ভেতরের সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

১ নম্বর সেলে পাঁচটি কক্ষ। সেখানে রাখা হতো জঙ্গিসহ দুর্ধর্ষ আসামিদের। সেখানে কোনো কিছু পোড়ার চিহ্ন না থাকলেও সাধারণ সেল স্বর্ণলতা, শিউলি ও পলাশ সবটিতে অগ্নিসংযোগের চিহ্ন দেখা গেছে। এ ছাড়া কারাগারের ক্যান্টিনের সব কিছু লুট করে সেখানে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
 
জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, কারাগারে ৮২৬ জন আসামি ছিল। অস্ত্রাগার থেকে ৬৬টি চায়নিজ রাইফেল ও ১৯টি শর্টগান লুট করা হয়। এছাড়া রাইফেলের ৭ হাজার গুলি ও শর্টগানের এক হাজার ১৫টি গুলি লুট করে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা।

তিনি বলেন, কারাগারের ভেতরে কয়েকটি বন্দিশালায় অগ্নিসংযোগ করেছে দুর্বৃত্তরা। কারাগারের প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কারাগারের অবশিষ্ট বলতে কিছু নেই। দুর্বৃত্তদের প্রায় সবাই মধ্যম বয়সী। অনেকে মাক্স পরা ছিল।

তিনি জানান, শুক্রবার কারাগারে মোট ১০৪ জন দায়িত্বরত ছিল। আত্মরক্ষার্থে তারা গুলি করার সুযোগ পায়নি। ১০-১২ হাজার লোক। পিস্তল, চাপাতি, চায়নিজ কোড়াল, হকিস্টিক, লোহার রড, বড় বড় রাম দা, হ্যামারসহ দেশি অস্ত্র নিয়ে কারাগারে হামলা চালায়। 

কারারক্ষী সালাহ উদ্দিন মোল্লা জানান, দুর্বৃত্তরা প্রথমে পেছনের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে। তারপর কয়েকটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয় ও ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এর মধ্যেই চতুর্দিক থেকে কয়েক হাজার লোক কারাগারে প্রবেশ করে। পরে সবাই মিলে হ্যামার দিয়ে কারাগারের মূল ফটক ভেঙে ফেলে। আমাদের যারা পোশাক পরিহিত ছিল, তাদের প্রচণ্ড মারধর করে।

কারারক্ষী পাভেল বলেন, চতুর্দিক থেকে মৌমাছির মতো একসঙ্গে আক্রমণ চালিয়ে দুর্বৃত্তরা গেট ও সব অস্ত্র তাদের দখলে নিয়ে নেয়।

কারাগারের মূল ফটকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কারারক্ষী নাজিমুর রহমান বলেন, হ্যামার দিয়ে যখন মূল ফটকে সজোরে ধাক্কা দেয়, তখন ফটকের ছিটকিনি খুলে যায়। আমরা বস্তা, টেবিল দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করেছি। ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের কেউ সহযোগিতা করেনি। আমরা যে আমাদের অস্ত্র নিয়ে প্রতিরোধ করব, সেই পরিবেশ ছিল না। আমাদের প্রতিটি বন্দি লকারে ছিল। তারা প্রতিটি তালা ভেঙে বন্দিদের নিয়ে গেছে।

এদিকে গত শনিবার সকাল থেকে সাধারণ লোকজন কারাগারের ভেতরে প্রবেশ করে সেখানকার গাছের ফলমূল, কয়েদি সেলের পুরনো কাপড়চোপড়, থালা-বাটি, বালতি, বঙ্গবন্ধু বুক কর্নারের বিভিন্ন বইসহ মালামাল নিয়ে যায়। সাদা পোশাকে কারারক্ষীরা বাধা দিলেও তারা কিছু শোনেনি।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

পরিদর্শন শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘নরসিংদীর এই কারাগার ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগও করা হয়েছে। অস্ত্রাগার লুট করেছে, যেসব জঙ্গি আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল। আমাদের পুলিশ বাহিনী যাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ফলো করে আটক করেছিল। এদের মধ্যে ৯ জন ছিল নরসিংদী কারাগারে। তাদের দুষ্কৃতকারীরা মুক্ত করে নিয়ে গেছে। তাহলে মূল উদ্দেশ্যটা কি আপনারা বুঝতে পারছেন।’

এমএসএ