‘আমার চোহে সমস্যা, হাঁটতে পারি না। তাও সন্তানেক আমি তদবির করছি। আহারে কইলজার টুকরা, মানুষের বাড়িতে বাড়িতে কাজ কইরা খিলায়া আমি সন্তানের লেহাপড়া করাইছি গো। আমার সন্তান হত্যার বিচার চাই, ন্যায্য বিচার আমি চাই। আমার সন্তানকে কী করল, আমার বেটা চাই। আমার সন্তান কোনোদিন গ্রামে নারাই করে নাই, আমার সবুজ শান্ত। আমাক বেটা আইনা দেও বাবা। আমি কত দুঃখিনী মাও, আমি কত দুঃখ-কষ্ট কইরা বেটাক লেখাপড়া করাইছি।’ 

এভাবেই আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংঘর্ষে নিহত ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী সবুজ আলীর মা সূর্য বানু। 

মঙ্গলবার (১৬জুলাই) কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হন তিনি।

নিহত সবুজের বাড়ি নীলফামারী সদর উপজেলার চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের আরাজী দলুয়া বাংলাবাজার গ্রামে। একমাত্র বাড়ির ভিটের আট শতক জমি ছাড়া তেমন কোনো সম্পদ নেই সবুজ আলীর পরিবারের। বাবা আব্দুর রহিম বাদশা ভ্যানচালক এবং সূর্য বানু কাজ করেন অন্যের বাড়িতে। দুজনের সামান্য আয়ে ছেলেকে পড়াচ্ছিলেন ঢাকা কলেজে। স্বপ্ন দেখছিলেন ছেলে লেখাপড়া করে ধরবে সংসারের হাল। কিন্তু নিমেষেই সে স্বপ্ন নিভে গেল মা–বাবার।

জানা গেছে, চার ভাই এক বোনের মধ্যে সবুজ আলী তৃতীয়। সবার বড় ভাই সুজাব আলী একজন প্রতিবন্ধী। মেজ ভাই নুরুন্নবী ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে সংসার খরচে কিছুটা জোগান দেন। একমাত্র বোন বাছিরণ বেগমের বিয়ে হয়েছে। সবুজ আলী ঢাকা কলেজে পরিসংখ্যান বিভাগে অনার্স শেষে ভর্তি হয়েছেন মাস্টার্সে। তার ছোট ভাই শাহ সুলতান পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ সরকারি কলেজে একাদশ শ্রেণীতে পড়েন।

জেলা শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে সবুজ আলীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে মা সূর্য বানু শয্যাশায়ী। ছেলের স্মৃতিতে মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল নানা প্রলাপ। তার বাবা আব্দুর রহিম বাদশা নেই বাড়িতে। প্রতিবেশীরা জানায়, গত দুই মাস আগে সবুজের টাকার প্রয়োজনে জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বনের ভ্যানটি বিক্রি করেছেন তিনি। এখন জীবন-জীবিকার তাগিদে তিনি শ্রমিকের কাজে রয়েছেন ঢাকার মানিকগঞ্জ জেলায়। সবুজের মৃত্যুর খবর বাড়িতে এলেও মোবাইল ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না তার বাবাকে।

সবুজের মা সূর্য বানু বলেন, ‘আমার বাবার হ্যাতে কয়দিন কথা কইনা। নাতি নইয়া একদিন কথা কইছি, আর কথা কয় নাই আমার বাবা। কালকে ফোন দিছি, হ্যার ফোন বন্ধ, দুইবার ফোন দিছি, ফোন বন্ধ। রাইত ২টার সময় মানুষ এইহানদি হাঁটা-চলা করতাছে, একটা চেংড়া আইসা আমাক ডাক দিছে। আমার বড় বেটার নম্বর চায়। নম্বর চাইস ক্যা, কয় যে সবুজের কাছে কী ফোন দিছিলেন। বলি ফোন দিছিলাম দুইবার, ফোন বন্ধ দেহাইছে। বলি কারে, সবুজের কী হইছে? তখন তো আমার মনে ডাং পইরা গেল।’

তিনি বলেন, ‘আমার সবুজ বেটা যদি এক দিন ফোন না ধরে, আমি পাগল হয়া যাই। এমনে আমার ওই সন্তান, আমি মাও যেই দিনেই হ্যারে মনে করি ওই দিনেই আমার বেটা ফোন দেয়। কালকা থাইকা ফোন পাইনাই, সারা রাইত ঘুমাই নাই। আমি কানতাছি আল্লার কাছে, আমার বেটা ফোন ধরল না, কহন রাইত পোহাইব, আমি কার কাছে যামু। কার কাছে যায়া আমার বেটার খোঁজখবর নিমু। হের লাইগা আল্লাহ-বিল্লা করতাছি কহন রাইত পোহাইব। তার মধ্যে রাইত দুইটার সময় ওই মোবাইল নাম্বারের লাইগা আইছে।’

সবুজের ছোট ভাই শাহ সুলতান জানান, গত ১৩ জুলাই সকাল পৌঁনে ৮টার দিকে সবুজের শেষ কথা হয়েছিল পরিবারের সঙ্গে। সেদিন নিজে ফোন করে মাসহ সবার খোঁজখবর নিয়েছেন। জানিয়েছিলেন ভালো থাকার কথা।

চওড়াবড়গাছা ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজুল ইসলাম বলেন, সবুজ আলী আমার প্রতিবেশী। তার বাবা ভ্যান চালিয়ে অনেক কষ্টে ছেলের লেখাপড়ার খরচ জোগান দিচ্ছিলেন। ছেলের মাস্টার্স ভর্তির টাকার প্রয়োজনে গত দুই মাস আগে সে ভ্যানটি বিক্রি করে দেন। এরপর সংসার চালাতে দিনমজুরের কাজে বর্তমানে রয়েছেন মানিকগঞ্জ জেলায়। ছেলের মৃত্যুর খবর দেওয়ার জন্য আমরা মোবাইলে তাকে চেষ্টা করে পাচ্ছি না।

হাফিজুল ইসলাম আরও বলেন, সবুজ শান্ত স্বভাবের। এলাকায় তাকে সকলে ভালো ছেলে হিসেবে চেনে। লেখাপড়ায় ভালো হওয়ায় বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না পরিবারের।

প্রতিবেশী অনার্সপড়ুয়া শিক্ষার্থী কাওছার আলী বলেন, সবুজ আলী আমার এলাকার বড় ভাই। তিনি ২০১৮-২০১৯ শিক্ষাবর্ষে পরিসংখ্যান বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা কলেজে। সম্প্রতি অনার্স পর্ব শেষে মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছেন বলে আমি জানি। কলেজের উত্তর ছাত্রাবাসের ২০৫ নম্বর কক্ষে থেকে লেখাপড়া করতেন। পাশাপাশি একটি ফটোস্ট্যাট দোকানে কাজ করতেন।

এদিকে, সবুজ আলীকে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা দাবি করে নীলফামারীতে সংবাদ সম্মেলন করেছে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ। বুধবার (১৭জুলাই) দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে ওই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন নীলফামারী-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।

সংবাদ সম্মেলনে সংসদ সদস্য আসাদুজ্জামান নূর বলেন, সবুজ আলী আমাদের সন্তান। একজন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। তার বাবা একজন ভ্যানচালক, যার ভাই ঢাকায় গার্মেন্টসের একজন শ্রমিক। সবুজ আলীকে ঘিরে ওই পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নটা কিন্তু এক নিমেষে নিভে গেল। 

শরিফুল ইসলাম/কেএ