কোটাবিরোধী আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদের অসহায় পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছেন শত শত মানুষ। অনেকেই নিহত আবু সাঈদের পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতার পাশাপাশি ভরণপোষণের দায়িত্ব নেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।

মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) দুপুরে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মিছিলের সম্মুখ থেকে বুক পেতে দেওয়া আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন।

জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে শহরের লালবাগ এলাকা থেকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের দিকে যান। এরপর ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে পুলিশ ও ছাত্রলীগ তাদের বাধা দেয়। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ বাধে। তখন পুলিশ শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে রাবার বুলেট, টিয়ার শেলসহ কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে মিছিলের সম্মুখ ছিলেন আবু সাঈদ। এই আন্দোলনে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি।

এদিকে আবু সাঈদের মৃত্যুর সংবাদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে শোকার্ত শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদী পোস্টের সঙ্গে অনেক হৃদয়বান মানুষ নিহতের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ব্যক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট দিতে থাকেন। তাদের সহযোগিতার মনোভাবমূলক পোস্টগুলো মুহূর্তেই সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।

এমন কয়েকটি পোস্ট ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদকের নজরে এসেছে। যার মধ্যে পারভেজ হাসান নামে একজন লিখেছেন, ‘নিহত আবু সাঈদের পরিবারকে আমি প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা বাজার খরচ দিতে চাই। যতদিন আমার সামর্থ্য আছে, কেউ তাদের বড় বোনের নম্বর সংগ্রহ করে দিয়েন প্লিজ।’

পারভেজ হাসানের এই পোস্টটি শত শত ফেসবুক ব্যবহারকারী শেয়ার করেছেন। অনেকেই আবার একই কথা ফেসবুকে পোস্ট করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন।

আব্দুল্লাহ আল জাবের লিখেছেন, ‘শহীদ আবু সাঈদের বাড়ির ঠিকানা এবং তার পরিবারের কারও নম্বর কেউ সংগ্রহ করে দিলে অনেক উপকার হতো। দয়া করে আমার ই-মেইলে তথ্যগুলো দিয়ে সাহায্য করবেন। আমরা তার পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।’

এদিকে সাঈদের মৃত্যুর পর মঙ্গলবার বিকেলে রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, তার বাড়িতে বিলাপ চলছে। সাঈদের মা ফ্যালফ্যাল করে সবার দিকে চেয়ে আছেন। মাঝেমধ্যে বাবা বাবা বলে চিৎকার দিয়ে উঠছেন। নিহত সাঈদের বোন সুমি আর্তনাদ করে বলেন, ‘হামার ভাইকে ওরা মেরে ফেলল ক্যান? হামার ভাই বেঁচে থাকলে হামার হেরে স্বপ্ন পূরণ হলো হয়। কেটা হামাক এনা বোন কয়া ডাকপি রে।’

নিহত আবু সাঈদ রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বাবনপুর গ্রামের মকবুল হোসেনের ছেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আবু সাঈদের বাবা মকবুল হো‌সেন পেশায় একজন দিনমজুর। অর্থাভাবে কোনো ছেলে-মেয়েকে লেখাপড়া করাতে পারেননি তিনি। আবু সাঈদ ছোট থেকেই ছিল অত্যন্ত মেধাবী। ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিল আবু সাঈদ। তাকে ঘিরে আকাশসম স্বপ্ন ছিল দরিদ্র মা-বাবার।

আবু সাঈদকে হারিয়ে মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে পরিবারটির। কারণ সাঈদ তার নিজ চেষ্টায় লেখাপড়া করে এতদূর পর্যন্ত এসেছিলেন। মেধা ও আচরণে গ্রামে সবার প্রিয় ছিল সাঈদ। সেই ছেলেকে হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে শোকে পাথর হয়ে গেছেন মা মনোয়ারা বেগম।

জানা গেছে, ছোট থেকেই আবু সাঈদ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। তার ব্যবহারে তার প্রতি সবাই মুগ্ধ ছিল। তিনি স্থানীয় জুনুদের পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। পরে এলাকার খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন জি‌পিএ-৫ পে‌য়ে এসএসসি পাস করেন। এর পর রংপুর সরকা‌রি কলে‌জ থেকেও এইচএসসিতে জি‌পিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। পরে বেগম রো‌কেয়া‌ বিশ্ব‌বিদ্যাল‌য়ে ইং‌রে‌জি বিভাগে ভ‌র্তি হন আবু সাঈদ। বেঁচে থাকলে আবু সাঈদ জীবনে অনেক বড় হতেন এবং পরিবারসহ এলাকার জন্য যথেষ্ট অবদান রাখতেন বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।

পরিবারের সবার ছোট হলেও আবু সাঈদের টিউশন আর আরেক ভাই পোশাকশ্রমিক আবু হোসেনের টাকায় চলতো তাদের বৃদ্ধ বাবার পরিবার। ছয় ভাইয়ের মধ্যে আবু সাঈদের বড় ভাই বকুল মিয়া (৪৫) ভ্যানচালক, সুলতান মিয়া (৪০) কৃষিকাজ,  রমজান আলী (৩৭) মুদি দোকানি, এবং আবু রায়হান (৩০) কৃষিকাজ করেন। নয় ভাই-বোনের মধ্যে আবু রায়হান ও আবু সাঈদ ছাড়া সকলের বিয়ে হয়েছে।

আবু সাঈদের চাচাতো ভাই ওমর ফারুক ঢাকা পোস্টের এই প্রতিবেদককে বলেন, খুব কষ্ট করে আবু সাঈদ পড়াশোনা করত। তার পরিবারের তো সেই সামর্থ্য নেই। এ কারণে অন্য কোনো ভাই-বোন লেখাপড়া করতে পারেনি। আবু সাঈদ খুবই মেধাবী ছিল। পরিবারের আশা ছিল সাঈদ পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হবে। অভাবের সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু স্বপ্ন এখন তছনছ হয়ে গেল।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার ভাইটা (আবু সাঈদ) বুক পেতে দিলো আর ওরা গুলি চালিয়ে দিলো! কি অপরাধ ছিল ওর। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার সংস্কার চাওয়া কি মৃত্যুযোগ্য অপরাধ? এখন এই অসহায় পরিবারের কি হবে? কারা আমার চাচা-চাচিকে দেখাশোনা করবে? সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। কারণ আমার চাচা দিনমজুর হলেও এখন শারীরিক কারণে আগের মতো কাজ করতে পারে না।

আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা খুব কষ্টে বড় হয়েছি। মা-বাবাকে ভরণপোষণ দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। সাঈদ আর হোসেন ওরা আমার মা-বাবাকে দেখাশুনা করত। ওদের টাকায় আমার মা-বাবার সংসার চলতো। এখন আমাদের আশার প্রদীপ নিভে গেল। এমন সময়ে ভাইয়ের মৃত মুখটা দেখে খুব কষ্ট হয়েছে। মনে হয় পুলিশ আমাদেরকে মারল কেন? ভাইটা আমাদের সাহস-শক্তি ছিল।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসন আর বিশ্ববিদ্যালয় কেউ আমাদের কথা ভাবেনি। তারা যদি ভাবত তাহলে আমার মায়ের বুক খালি করতে পারত! আজ (বুধবার) ভাইকে দাফন করেছি। হাজার হাজার মানুষ ওর জন্য কান্না করেছে।

আবু সাঈদের পরিবারকে সহযোগিতা বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে এই নম্বরে ০১৭৩৭৭৫৫২১২ (আবু হোসেন), ০১৭৩৬১৭১৮৭৬ (রমজান আলী) অথবা ০১৭৩৮৫৪১৮৬৭ (ওমর ফারুক)।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ