কয়েক বছর আগে শিক্ষকতা পেশা থেকে অবসরে গেছেন আমির হোসেন মিয়া। অবসর জীবনে তেমন কিছুই করেন না তিনি। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে পাঁচ সদস্যের পরিবার তার। তবে শেষ জীবনে এসে যমুনা নদীর ভাঙনের কবলে বাপ-দাদার ভিটেবাড়ি। মায়ের নামে থাকা দুই শতাংশ জমির ওপর বসতবাড়িটি নদীতে চলে গেলে পরিবার নিয়ে থাকার জায়গাটুকুও থাকবে না এই শিক্ষকের।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক আমির হোসেন মিয়ার মতো আরও অনেকের বসতবাড়িসহ ফসলি জমি যমুনার নদীতে বিলীন হয়েছে। বর্ষার সময় নদীতে পানি বাড়ায় তীব্র স্রোত আর ঢেউয়ের কারণে ভাঙন দেখা দেয়। তবে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পাড়ে খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের কারণে এই ভাঙন হয় বলে অভিযোগ করেন ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসী।

জানা গেছে, ভাঙন থেকে রক্ষা পেতে শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের আলোকদিয়া, চর শিবালয়, ঝিকুটিয়া ও সমেজঘর গ্রামের শতাধিক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নিয়েছে। উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের পূর্বপাড়ে ঝিকুটিয়া, সমেজঘর, দক্ষিণ তেওতা, তেওতা ও সাতুরিয়া এবং পশ্চিম পাড়ে আলোকদিয়া, চর শিবালয় গ্রামের এ বছর প্রবল ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীভাঙনে গত এক মাসে এসব গ্রামের প্রায় ১৮০টি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ভাঙনে কবলে পড়েছে অসংখ্য বসতবাড়ি, ফসলি জমি, রাস্তাঘাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা।

শুষ্ক মৌসুমে যমুনা নদীর পূর্বপাড়ের সাতুরিয়া থেকে ঝিকুটিয়া পর্যন্ত ২০ থেকে ২৫টি খননযন্ত্র (ড্রেজার) দিয়ে অবৈধভাবে নদী থেকে বালু উত্তোলন করায় সেখানে গর্তের সৃষ্টি হয়। এতে বর্ষা মৌসুমের নদীতে পানি বাড়লে তীব্র স্রোত ও ঢেউয়ের কারণে এই ভাঙন আরও তীব্রতর হয়। ভাঙনকবলিত এলাকার উজানে জাফরগঞ্জ থেকে নদীরক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ হওয়ায় সেখানে ভাঙন থেমেছে। তবে সাতুরিয়া থেকে নেহালপুর পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ না হওয়ায় থামানো যাচ্ছে না নদীভাঙন। ফলে প্রতিবছরই ভিটেবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে এসব এলাকার বাসিন্দারা।

সরেজমিনে শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে উপজেলার সমেজঘর ও ঝিকুটিয়া গ্রামে দেখা গেছে, যমুনা নদীর আগ্রাসী ভাঙনের চিত্র। ভাঙনে ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি বসতবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আংশিক বিলীন হওয়া বসতবাড়ির ঘর সরিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। ভাঙন ঝুঁকিতে থাকা কয়েকটি পরিবার অসহায় হয়ে পড়েছেন। যমুনায় আংশিক বিলীন হওয়ার বসতবাড়ির ঘরটির দিকে তাকিয়ে আছেন তেওতা একাডেমির অবসপ্রাপ্ত শিক্ষক আমির হোসেন মিয়া।

আলোকদিয়া গ্রামে নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে প্রায় দুই বছর আগে দক্ষিণ তেওতা গ্রামে নতুন করে বাড়ি করেন শ্রমজীবী দুই ভাই ইউসুফ মোল্লা ও ইউনুস মোল্লা। এ বছর নদীভাঙনে নতুন করে তাদের বসতবাড়ির একাংশ নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঝুঁকিতে এ গ্রামের আরও কয়েকটি বসতবাড়ি।

ওই দুই সহোদরের বৃদ্ধা মা সালেহা বেগমের (৭০) সঙ্গে ভাঙনের বিষয়ে কথা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘তিন বছর আগে স্বামী মাইনুদ্দিন মোল্লা মারা গেছেন। আমাগো বাড়ি ছিল নদীর ওপারে (পশ্চিমপাড়) আলোকদিয়া চরে। সন্তানগো লইয়্যা স্বামীর রাইখ্যা যাওয়া বসতভিটাই আছিলাম। কিন্তু বছর দুই আগে যমুনায় সব ক্যাইরা নিছে। পরে সন্তানগো লগে এইহানে নতুন করে বাড়ি করছি। অহন এই বাড়িও নদীতে লইয়্যা যাইতাছে, মনে হইতাছে নদী আমাগো পিছুই ছাড়ছে না।’

ঝিকুটিয়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আমির হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমাগো পূর্বপুরুষের বসতবাড়িসহ প্রায় ৩০ বিঘা জমি এই যমুনায় বিলীন হয়েছে। সেই ১৯৬৯ সাল থেকে নদীভাঙনের কারণে সব নদীগর্ভে চলে গেছে। এখন থাকার মতো দুই শতক জমির মধ্যে তিনটি ঘর রয়েছে। থাকার একটি ঘরের আংশিক নদীতে বিলীন, বাকি দুটি ঘরও নদীগর্ভে বিলীনের উপক্রম হয়েছে। শেষ বয়সে এসে যমুনার আগ্রাসী ভাঙনে বাপ-দাদার রেখে যাওয়া কোনো চিহ্নও রক্ষা হবে না।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যমুনা নদীর পশ্চিমপাড়ে আলোকদিয়া ও চর শিবালয় গ্রামে ভাঙন আতঙ্কে সরিয়ে নেওয়া ভিটায় দেখা দিয়েছে বড় বড় ফাটল। এসব ফাটলে আছড়ে পড়ছে ঢেউ। নদীর ঢেউ আছড়ে পড়ছে নদীর তীরে। এতে তীরের মাটি নদীর তলদেশে সরে গিয়ে একটু একটু করে ভেঙে পড়ছে বসতভিটা।

উপজেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, আলোকদিয়া ও চর শিবালয় এলাকায় চলমান নদীভাঙনে ১৫০টি পরিবার বসতভিটা হারিয়েছে। এ ছাড়া ঝিকুটিয়া, সমেজঘর, তেওতা এলাকায় আরও ৩০টির মতো বসতভিটা নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোকে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবারকে সহযোগিতা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া বসতভিটা হারানো পরিবারগুলোর আবাসস্থল নির্মাণেরও উদ্যোগ নেওয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বেলাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভাঙনকবলিত এলাকাগুলো পরিদর্শন করা হচ্ছে। সেখানে ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর স্থায়ী বসবাসের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হবে। স্থানীয় সংসদ সদস্য ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে জরুরি ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

তবে ত্রাণের পরিবর্তে ভাঙন রোধে নদীর তীরে স্থায়ী বাঁধের দাবি করেন ভুক্তভোগীরা। ভাঙনের শিকার ঝিকুটিয়া গ্রামের দেলোয়ার হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আজকে আমার বাড়ি নদীতে বিলীনের পথে, আমি ত্রাণ দিয়া কি করমু, আমরা ত্রাণ চাই না। ভাঙন রোধে এইহান দিয়া স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হোক। আমার মতো যারা ভিটাহারা হইছে তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা কইর‌্যা দিলেই আমরা খুশি।’

এদিকে আপৎকালীন ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি লম্বা জিও টিউব ফেলার কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো। তবে ভাঙন দেখা দেওয়ার আগে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল এলাকাবাসী। তখন ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে অনেকের বাড়ি নদীতে চলে গেছে বলে জানায় ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা।

পাউবোর মানিকগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের সমেজঘর, ঝিকুটিয়া গ্রামের ভাঙনপ্রবণ এলাকায় পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিপূর্ণ ১২৮ মিটার এলাকায় আপৎকালীন ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ফেলার কাজ শুরু হয়েছে। এ ছাড়া ভাঙনপ্রবল দেড় কিলোমিটার এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে পরিকল্পনা রয়েছে।

এমজেইউ