মা ফাতেমা বেগমের সঙ্গে আব্দুল্লাহ আল মারুফ জিয়াম

রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে চিকিৎসকদের ভুলে অস্ত্রোপচারের পর ফাতেমা বেগম (৪৫) নামের এক রোগীর শরীরে ভিন্ন গ্রুপের রক্ত দেওয়া হয়। এ ঘটনার ১৮ দিন পর গত ১০ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই রোগীর মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে দাবি করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ভুক্তভোগী পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছেন ফাতেমা বেগমের সন্তানরা।

শনিবার (১৩ জুলাই) দুপুরে দিনাজপুর সার্কিট হাউসে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনের সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি প্রদান করেন ফাতেমা বেগমের ছেলে আব্দুল্লাহ আল মারুফ জিয়াম। এ সময় সঙ্গে জিয়ামের বোন শাহেরা খাতুনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন উল্লেখ করে আব্দুল্লাহ আল মারুফ জিয়াম ঢাকা পোস্টকে জানান, শনিবার দুপুরে তার একমাত্র বোনকে সঙ্গে নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তার মায়ের মৃত্যুর নেপথ্যের ঘটনা তুলে ধরেন। পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে একটি লিখিত অভিযোগ স্মারকলিপি আকারে প্রদান করেন।

আব্দুল্লাহ আল মারুফ জিয়াম

জিয়াম আরও জানান, গত ২১ জুন অস্ত্রোপচারের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন ফাতেমা বেগম। রোগীকে ট্রান্সমিশন বিভাগে নিয়ে রক্ত পরীক্ষার পর জানানো হয়, তার রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজিটিভ। এরপর ‘এ’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহ করা হয়।  হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তা ক্রস ম্যাচ করে নিশ্চিত করে, রক্তের গ্রুপ ঠিক আছে। এরপর ২২ জুন ফাতেমার জরায়ুর অস্ত্রোপচার করা হয়। এক ব্যাগ রক্ত শরীরে যাওয়ার পরপরই রক্তক্ষরণ, শরীর ফুলে যাওয়া, খিঁচুনিসহ নানা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া শুরু হয়। কারণ জানতে না পেরে পরদিন চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন, আবার অস্ত্রোপচার করবেন। তখন আবার স্বজনদের রক্ত সংগ্রহ করতে বলা হয়। স্বজনরা এবারও তিন ব্যাগ ‘এ’ পজিটিভ রক্ত সংগ্রহ করেন। কিন্তু এবার আর ক্রস ম্যাচিং করা হয়নি। এতে চিকিৎসকদের সন্দেহ হয়। এরপর হাসপাতাল ও বাইরে থেকে ফাতেমার রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায়, তার রক্তের গ্রুপ আসলে ‘ও’ পজিটিভ।

চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন, রক্তের গ্রুপ নির্ণয় করতে ভুল হওয়ায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। এরপর ফাতেমাকে আইসিইউতে নেওয়া হয়। ২৯ জুন পর্যন্ত আইসিইউতে রাখার পরও অবস্থার অবনতি হলে পরদিন তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর বুধবার ভোর ৪টার দিকে ফাতেমা বেগম চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান, যোগ করেন জিয়াম।

জিয়াম বলেন, এর আগে মায়ের চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে গত ৭ জুলাই আমি সহপাঠী, বন্ধু ও জিলা স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে হাসপাতাল ঘেরাও করে চার ঘণ্টা অবস্থান করি। ভুল চিকিৎসায় জীবন সংকটাপন্ন আমার মায়ের জন্য মেডিসিন, গাইনি, নেফ্রোলজি, গ্যাস্ট্রোর ডাক্তার একসঙ্গে বসে বোর্ড করে চিকিৎসা করানোসহ একটি আইসিইউ বেডের ব্যবস্থা করা এবং চিকিৎসা ব্যয় মেডিকেল কর্তৃপক্ষকে নিতে দাবি জানিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আমার মা চিকিৎসকদের ভুল আর সঠিক চিকিৎসার অভাবে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

ভুল গ্রুপের রক্ত শরীরে দিয়ে চিকিৎসকরা ফাতেমা বেগমকে মেরে ফেলেছেন দাবি করে তার ছেলে জিয়াম বলেন, আমার মাকে হত্যা করেছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তারা আমাকে এতিম করেছে। সহায়-সম্বল যা ছিল সব শেষ করেও আমরা মাকে বাঁচাতে পারলাম না। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। আমি এর সঠিক বিচার চাই। আমার একমাত্র বোনের বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি এখন বিঘ্নিত। পরিবারে উপার্জনক্ষম কেউ নেই। বাবা একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। বয়সের কারণে সেখান থেকে অবসরে আছেন। মা আমাদের সবকিছু ছিলেন, পুরো সংসার চালাতেন তিনি। এখন আমাদের কী হবে? আমার পড়াশোনা, ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি শঙ্কিত। এর দায় কে নেবে? আমরা মাকে হারিয়েছি, এখন বিচার চাই। ক্ষতিপূরণ চাই, আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা চাই।

ফাতেমা বেগম স্বামী-সন্তান নিয়ে রংপুর নগরীর কেরানীপাড়া চৌরাস্তা এলাকার একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুরে ভাতগ্রাম ইউনিয়নের খোদাবকস এলাকায়। মৃত্যুর পর সেখানে তার দাফন সম্পন্ন করা হয়েছে।

এদিকে ভুল রক্ত নির্ণয় ও রোগীর শরীরে দেওয়ার ঘটনায় গত ৩ জুলাই হেমাটোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক এ কে এম কামরুজ্জামানকে প্রধান করে ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দিতে না পারায় নতুন করে আরও পাঁচ দিন সময় তদন্ত কমিটিকে দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালের সামনে শিক্ষার্থীদের অবস্থান/ফাইল ফটো

এ বিষয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মোহাম্মাদ ইউনুস আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত কমিটি করেছি। উনারা তাড়াহুড়ো করে একটি অসম্পূর্ণ প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। সেখানে অভিযোগকারীর কোনো বক্তব্য ছিল না। এ কারণে তদন্ত কমিটিকে আরও পাঁচ দিন সময় দেওয়া হয়েছে যাতে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়।

তিনি অভিযোগ করেন, রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না। তাদেরকে তদন্ত কমিটি থেকে একাধিক ফোন করা হলেও তারা কেউ সাড়া দেয়নি। এখন একপক্ষের বক্তব্য দিয়ে তো কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। দুই পক্ষের বক্তব্য থাকলে তদন্ত প্রতিবেদন ভালো হবে। প্রকৃত ঘটনা জানতে আমরা চেষ্টা করছি।

ফরহাদুজ্জামান ফারুক/এমজেইউ