কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার যাদুবয়রা ইউনিয়নের গড়াই নদীর পাড়ঘেঁষা এনায়েতপুর গ্রামের মৃত ফজলু শেখের ছেলে জাফর শেখ। জাফররা তিনভাই। তিন ভাইয়ের ৬৬ শতাংশ জমির মধ্যে ৪৪ শতাংশ নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। এখন টিকে আছে ১৮ শতাংশ। সেখানে জাফর শেখ বসবাস করেন। তার অন্য দুই ভাই সাত্তার শেখ ও সালাম শেখ জায়গা জমির অভাবে অন্যত্র চলে গেছেন। সেখানে রয়ে গেছেন জাফর শেখ।

তবে জমি অধিগ্রহণ না করেই জাফর শেখের শেষ সম্বল বসত ঘরটি ভেঙে দিয়ে তার জমির ওপর নির্মাণ করা হচ্ছে বেড়িবাঁধ। ফলে ক্ষতিপূরণের টাকাও পাননি তিনি। অধিগ্রহণসংক্রান্ত কোনো লিখিত নোটিশ পাননি বলে অভিযোগ তার। ফলে ক্ষতিপূরণের টাকাও পাননি কেউ।

একই এলাকার সত্তরোর্ধ্ব বিধবা সাকিরন নেছা। ছেলের পরিবারের সঙ্গে টিনের চালার ছোট্ট এক ঘুপরি ঘরে বসবাস করেন। একসময় সবই ছিল তাদের। সুখে-শান্তিতে ভরা ছিল সংসার। প্রায় চার পুরুষ ধরে নদী ভাঙনে বাঁশঝাড়, বাগান, পুকুরসহ মাঠের সব জমি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে গেছে। শেষ সম্বল ৫ শতকের বসতভিটাও এখন বেড়িবাঁধের গ্রাসে।

সাকিরন নেছা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, নদী ভাঙনে সব গেছে। বাকি ছিলো মাথার উপরের এই চালটুকু। বাঁধ বানাতি ব্যাটারা সেটুকু ভাঙি দেচ্ছে। আমরা এহুন কনে যায়া দাঁড়াবো। ব্যাটারা বাঁধ বানাতি ঘর ভাঙতেছে।

শুধু বৃদ্ধা সাকিরন নেছা ও জাফর শেখ নয়। গ্রামের অন্তত ১৮টি পরিবারের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ঘরবাড়ি ভেঙে ও শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ না করে ব্যক্তিমালিকানাধীন ভূমির ওপর বাঁধের কাজ শুরু করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। এতে বাঁধের পাশে ঘরবাড়ি ও জমি থাকা মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।

তাদের অভিযোগ, ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়ার আগেই তাদের সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। টাকা পাবেন কি না, তা নিয়েও তাদের শঙ্কা রয়েছে। ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন তারা। এঘটনায় গত ৩ জুলাই কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গড়াই নদীর পাড় ভাঙনরোধে জনস্বার্থে উপজেলার যদুবয়রা ইউনিয়নের এনায়েতপুর গ্রামের ইনতার বাড়ি থেকে পাচো শেখের বাড়ি পর্যন্ত ৫০০ মিটার পাকা বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু করছে পাউবো। ৫০০ মিটার বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য ১৫ কোটি ৯৪ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সৈকত ট্রেডার্স নামে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটি করছে। ইতোমধ্যে বাঁধের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী তিন-চার মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করা হবে।

ভুক্তভোগী ও স্থানীয়রা বলেন, গড়াই নদীর পাড়ের অন্তত ১৮টি পরিবারের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ঘরবাড়ি ভেঙে ও শতাধিক গাছ কেটে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। জমি অধিগ্রহণ না করেই বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। অধিগ্রহণসংক্রান্ত কোনো লিখিত নোটিশ পাইনি। ফলে ক্ষতিপূরণের টাকাও পাননি কেউ। ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন তারা। 

একই এলাকার গৃহিণী সালেহা খাতুন জানান, নদীতে ভাঙতে ভাঙতে আর ৭ শতাংশ জমিতে ঘরবাড়ি আছে। তিন সদস্যসের পরিবার, বাঁধের জন্য জমি দিলে আর মাথা গুজার ঠাঁই মিলবে না। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বারবার ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। সরকার যদি আমাদের ব্যক্তি মালিকানার জমির ওপর বেড়িবাঁধ নির্মাণ করে, তাহলে আমাদের ক্ষতিপূরণ দিক। আমাদের সমস্যার সমাধান করা হোক।

বাঁধ নির্মাণ কাজের দেখাশোনা করছেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের আবু বক্কর। তিনি জানান, বাঁধ নির্মাণ করতে হলে ব্যক্তিগত জমি লাগবেই। সেজন্য কিছু গাছপালা কাটা হয়েছে। আংশিক ঘরবাড়িও ভাঙা হয়েছে।

বাসিন্দাদের অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার মুরাদ হোসেন জানান, পাউবো কর্তৃপক্ষ যেখানে জমি বুঝিয়ে দিয়েছে। তিনি সেখানেই বাঁধ নির্মাণ করছেন। এখানে তার কিছু করার নেই।

অন্যদিকে, বাঁধ নির্মাণের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা বা মানুষের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নিয়ম নেই বলে জানিয়েছেন কুষ্টিয়া পাউবোর উপ সহকারি প্রকৌশলী ইয়ামিন হক। তিনি বলেন, জনস্বার্থে এবং জনগণের দাবির প্রেক্ষিতে বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। জনগণ কাজে বাধা দিলে বাঁধ নির্মাণ হবে না।

এ ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন যদুবয়রা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি জানান, জনগণের দাবি যৌক্তিক, তাদের জমির বৈধ কাগজ আছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলবেন।

এবিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) এস এম মিকাইল ইসলাম জানান, একজন বাসিন্দা লিখিত অভিযোগ করেছেন। তিনি সরেজমিন পরিদর্শন করে পাউবোর সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

রাজু আহমেদ/পিএইচ