বর্তমানে বাংলাদেশ কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর আধিক্যের মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। এমন জনগোষ্ঠী দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলেও বাংলাদেশে ঘটছে বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশে কোনো কাজেই সম্পৃক্ত নেই এমন লোকের সংখ্যা ৫৩ শতাংশ। এতে জেলা শহর ফেনী আরও এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। এই জনপদের কর্মক্ষম প্রায় ৬০ শতাংশ জনগোষ্ঠী কোনো কাজেই সম্পৃক্ত নেই। 

এমন চিত্রের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে কথা বললে উঠে আসে নানা তথ্য। 

সরেজমিনে ঢাকা পোস্টের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জেলা শহরের তুলনায় গ্রামে পরনির্ভরশীলতার হার বেশি। এতে শিক্ষাজীবনে পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর আর পড়াশোনা না করা, প্রবাসে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে ছুটে চলা ও নারীদের জন্য অনুকূল কর্ম পরিবেশ গড়ে না ওঠাসহ নানা কারণ ওঠে এসেছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমানে জেলায় মোট জনসংখ্যার ৫৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ পরনির্ভরশীল। যেখানে জাতীয়ভাবে নির্ভরশীলতার হার ৫৩ শতাংশ। জেলায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে শহরের তুলনায় গ্রামে এ হার বেশি। গ্রামে নির্ভরশীলতার হার ৬০ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও শহরে এ হার ৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সব জনগোষ্ঠী সর্বশেষ শুমারিকালে কোনো শিক্ষা, অর্থনৈতিক কাজ বা প্রশিক্ষণে নিয়োজিত ছিলেন না।

এইচএসসি পাস করে প্রবাসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সময় পার করছেন দাগনভূঞার রেজাউল করিম নামে এক যুবক। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, গত দুই বছর প্রবাসে যাওয়ার পরিকল্পনায় আর নতুন করে পড়াশোনা করিনি। এ সময়ে বাড়িতেই অবস্থান করেছি। মাস শেষে প্রবাসী বাবার পাঠানো টাকায় আমাদের সংসার চলে। সেজন্য নিজে আর কোনো কর্মে নিয়োজিত হইনি। 

একইভাবে এসএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার পর থেকে তিনবছর ধরে বাড়িতে অবস্থান করছেন পরশুরামের রাশেদা আক্তার নামে এক তরুণী। পরিবার ভালো পাত্র পেলে বিয়ে দেবেন এমন কথায় তিনিও কোন কাজ না করে বাড়িতেই সময় পার করছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্য মতে, ফেনীতে মোট জনসংখ্যা ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৮৯৬ জন। তার মধ্যে ৪৭ দশমিক ৩৩ শতাংশ পুরুষ এবং ৫১ দশমিক ৬৭ শতাংশ নারী। মোট পরিবারের সংখ্যা ৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৬৪। জেলায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ, যা ২০১১ সালের শুমারিতে ছিল ১ দশমিক ৪৬ শতাংশ। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ১ হাজার ৬৬৫ জন।

মোট জনসংখ্যার মধ্যে ৩ লাখ ৮৩ হাজার ৯৩৬ জন কর্মে নিয়োজিত, ৪ লাখ ৫৭ হাজার ১৫০ জন গৃহস্থালির কাজে ও ১৯ হাজার ১২৬ জন কর্মের খোঁজ করছেন। এতে দেখা যায়, জেলায় কাজে নিয়োজিত মোট জনসংখ্যার মধ্যে নারীর তুলনায় পুরুষের হার অনেক বেশি। একইভাবে বর্তমানে যারা কাজ খুঁজছে তাদের মধ্যেও নারীর চেয়ে পুরুষের হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। 

এছাড়া ৯ লাখ ৮০ হাজার ৪৩৩ জন কোনোরূপ কাজ করছে না। কোনোরূপ কাজ করছে না এমন জনগোষ্ঠীর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৫২ দশমিক ৯৪ শতাংশ ও নারী ৪৭ দশমিক ৬ শতাংশ। 

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, জেলায় ৭ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী পুরুষের মধ্যে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছে ১৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ, ৫ম-৯ম শ্রেণি পাস ৩৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ, এসএসসি-সমমান ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ২৬ দশমিক ১২ শতাংশ এবং ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ কখনো স্কুল-মাদরাসায় যায়নি।

অন্যদিকে একই বছর বয়সী নারীদের মধ্যে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পাস করেছে ১৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ, ৫ম-৯ম শ্রেণি পাস ৪১ দশমিক ১৬ শতাংশ, এসএসসি-সমমান ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ২৪ দশমিক ৭১ শতাংশ এবং ১৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ কখনো স্কুল-মাদরাসায় যায়নি। এছাড়া জেলার ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী পুরুষের মধ্যে এসএসসি ও তদূর্ধ্ব শ্রেণি পাস ৩৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ এবং একই বয়সী নারীদের মধ্যেই এ হার ২৯ দশমিক ৯১ শতাংশ। 

একই তথ্যে দেখা গেছে, ৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী জনগোষ্ঠীর মধ্যে কারিগরি শিক্ষায় পুরুষদের অংশগ্রহণ ৭৬ দশমিক ১০ শতাংশ এবং নারীদের হার ২৩ দশমিক ৯০ শতাংশ। 

উপজেলা ভিত্তিক প্রাপ্ত উপাত্তে দেখা যায়, ফেনী সদরে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ৩৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ কাজে নিয়োজিত এবং সোনাগাজীতে এ হার ৩৩ দশমিক ১ শতাংশ।

যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ফেনীর সহকারী পরিচালক সাইফ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেনীতে তরুণ-যুবকদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে স্বনির্ভর হওয়ার চেয়ে সাধারণত প্রবাস যাওয়ার ঝোঁক বেশি। তবুও মাঠপর্যায়ে এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা পর্যায়ে ৭৫৫টি ও ছশ উপজেলায় ২ হাজার ৫২০টি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জেলাপর্যায়ে বর্তমানে ছয়টি কোর্স চলমান রয়েছে। এছাড়া একটি প্রকল্পের আওতায় ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ চলছে। যেখানে বিদেশ গমনেচ্ছু যুবকদের আগ্রহ বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে। জেলায় প্রতি অর্থবছরে গড়ে তিন হাজারের বেশি যুবককে বিভিন্ন কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় বলে জানান এ কর্মকর্তা। 

ফেনীতে পরনির্ভরশীল জনসংখ্যা প্রসঙ্গে ইতোপূর্বে এক বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মুছাম্মৎ শাহীনা আক্তার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রচেষ্টার উদাহরণ সর্বশেষ প্রযুক্তিনির্ভর জনশুমারি এবং গৃহগণনা। নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনা করে সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছেন। এজন্য সবাইকে পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত হতে উৎসাহ দিতে হবে।

এদিকে বৃহস্পতিবার (১১ জুলাই) বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস উপলক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়। এ উপলক্ষ্যে র‍্যালি ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উপাত্ত ব্যবহার করি, সাম্যের ভিত্তিতে সহনশীল ভবিষ্যৎ গড়ি’। 

ঘটতে পারে পারিবারিক বিপর্যয়

উদ্বেগজনক হারে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর পরনির্ভরশীলতার কারণে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও জীবনযাত্রার মান কমার পাশাপাশি পারিবারিক জীবনেও বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ ও ফেনী ইউনিভার্সিটির ট্রেজারার প্রফেসর তায়বুল হক।

প্রফেসর তায়বুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী নির্ভরশীল হলে শুধু অর্থনীতিতে প্রভাব পড়বে এমন নয়। এটির কারণে যেমন আঞ্চলিকভাবে সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও জীবনযাত্রার মান কমবে তেমনি জাতীয় পর্যায়েও অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রভাব পড়বে। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে।

তিনি বলেন, ফেনীতে পরনির্ভরশীলতার এমন পরিসংখ্যান আমাদের জন্য শঙ্কার। এই হার অস্বাভাবিক। এজন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যদি স্বল্প মেয়াদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও সহায়তার ব্যবস্থা করেন তাহলে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। 

অর্থনীতিবিদ প্রফেসর তায়বুল হক আরও বলেন, যেসব তরুণ দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য সময় অপচয় করছে তাদেরও এই সময়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজে নিয়োজিত হতে হবে। এছাড়া নারীরা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সেলাই কাজ বা কুটির শিল্পে নিয়োজিত হতে পারেন। এতে প্রত্যেকে স্বনির্ভর হয়ে পরনির্ভরশীলতার এ হার কমে আসবে।

তারেক চৌধুরী/আরকে