বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে না বসে কলেজে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হাবিবার
বাবাহারা সন্তানদের নিয়ে মানবেতর জীবনসংগ্রাম করছিলেন মা তাসলিমা বেগম। অভাবের সংসারে কোনোমতে মেয়ে হাবিবাকে এসএসসি পরীক্ষা দিতে দিলেও মায়ের ভাবনা ছিল পরীক্ষার পর মেয়েকে বিয়ে দেবেন তিনি। কিন্তু হাবিবার স্বপ্ন ছিল কলেজে পড়ার। মায়ের মানবেতর জীবনসংগ্রামের কথা জানতে পেরে হাবিবার কলেজে ভর্তির স্বপ্ন পূরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুরের কমাড্যান্ট মো. মইনুল ইসলাম। কথা অনুযায়ী হাবিবার কলেজে ভর্তি নিশ্চিত করে বইখাতাসহ চেয়ার-টেবিল কিনে দিয়েছেন তিনি। তাই বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে না বসে কলেজে পড়ার স্বপ্ন পূরণ হলো হাবিবার।
বুধবার (১০ জুলাই) শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নসাশন ইউনিয়নের সরদার কান্দি গ্রামে হাবিবাদের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয় তার বইপত্রসহ অন্যান্য সামগ্রী।
বিজ্ঞাপন
প্রতিবছর মে মাসের দ্বিতীয় রোববার পালন করা হয় মা দিবস। গত মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবসের দিন হাবিবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল বের হয়। ওইদিন মা দিবস উপলক্ষ্যে হাবিবার মা তাসলিমা বেগম বলেছিলেন, ‘মেয়ে আজ যে সুসংবাদ দিয়েছে, তাতে আমি কষ্ট ভুলে গেছি’। এই শিরোনামে ঢাকা পোস্টে সংবাদ প্রকাশিত হলে ওই দিনই হাবিবার বাড়িতে গিয়ে তার পড়াশোনার খরচের দায়িত্ব নেন মো. মইনুল ইসলাম।
জানা যায়, চার সন্তান রেখে হাবিবার বাবা দুলাল সরদার মারা যান। এরপর হাবিবার মা তাসলিমা বেগম চার সন্তান নিয়ে শুরু করেন শুরু করেন জীবনসংগ্রাম। বাড়ির আঙিনায় শাকসবজি চাষ, সেলাই মেশিনে জামা তৈরিসহ বিভিন্ন কাজ করে ছেলে-মেয়ের আহার সংগ্রহ করতে হত তাসলিমাকে। অভাবের সংসারে হাবিবার কলেজে পড়াশোনার স্বপ্ন থাকলেও তার মা ও অন্যান্য ভাইবোনদের ইচ্ছে ছিল এসএসসি পরীক্ষার পর হাবিবাকে বিয়ে দেবেন। গত ১২ মে মা দিবসের দিনই হাবিবার এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হলে হাবিবা কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়। কিন্তু মেয়ের কৃতিত্বে মেয়েকে মিষ্টিমুখ করাবেন তো দূরের কথা, ঘরে ভালো-মন্দ কিছু রান্না করার মতো সম্বলও ছিল না তাসলিমা বেগমের। তবুও মা দিবস উপলক্ষ্যে নিজের সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তাসলিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়ে আজ যে সুসংবাদ দিয়েছে, তাতে আমি কষ্ট ভুলে গেছি। ঢাকা পোস্টে এমন সংবাদ প্রকাশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সংবাদটি নজরে পড়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুরের কমাড্যান্ট মো. মইনুল ইসলামের। পরবর্তীতে ওইদিনই তিনি মিষ্টি, নতুন জামা ও নগদ কিছু টাকা নিয়ে তাসলিমা বেগমের সঙ্গে দেখা করে হাবিবার পড়াশোনার ব্যয় বহন করতে চাইলে হাবিবার পরিবার তাতে সম্মতি প্রদান করেন। এতে বাল্যবিয়ের পিঁড়িতে না বসে কলেজে পড়ার স্বপ্ন আরও রঙিন হয় হাবিবার।
এরপর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড কলেজে ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলে হাবিবা খাতুনের আবেদনের প্রেক্ষিতে নড়িয়ার ডগ্রী ইসমাইল হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয় সে। হাবিবার ভর্তি ফিসহ অন্যান্য খরচ প্রদানের জন্য ওই কলেজ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনসার বাহিনী। হাবিবার পরিবারের বিস্তারিত জানতে পেরে তার ভর্তি ফি, বেতন ও পরীক্ষার ফি মওকুফ করে দেয় কলেজ প্রশাসন। এরপর আজ বুধবার দুপুরে হাবিবার বাড়িতে গিয়ে চেয়ার, টেবিলসহ একাদশ শ্রেণির এক সেট বই, খাতা-কলম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীসহ আনসার বাহিনী সম্পর্কিত বিভিন্ন বইপত্র তুলে দেন মো. মইনুল ইসলাম।
মেয়ে কলেজে ভর্তির পর এমন উপহার পেয়ে তাসলিমা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভেবেছিলাম আর পড়াব না মেয়েকে। বিয়ের চিন্তা করছিলাম আমিসহ পরিবারের সবাই। অভাবের কারণে আমার মেয়েকে কোনোদিন চেয়ার-টেবিলে পড়তে বসাতে পারিনি। বাবাহারা আমার মেয়ে কলেজে পড়বে ভাবতেও পারিনি। আমি মইনুল স্যারের জন্য দোয়া করি।
কলেজে ভর্তি নিশ্চিতের পর এসব উপকরণ পেয়ে হাবিবা খাতুন খুশিতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, মাসহ পরিবারের সবাই আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু মাকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর আনসার বাহিনী আমার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছে। আমাকে বিয়ে করতে হবে না, চেয়ার-টেবিলে বসে পড়াশোনা করতে পারব, এটা আমার কাছে বর্ণনাতীত আনন্দ সংবাদ। আপনাদের সকলের জন্য দোয়া করি আমি। আমার জন্যও দোয়া করবেন, যেন আমি শিক্ষক হয়ে অন্য এতিম ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে পড়াতে পারি।
ডগ্রী ইসমাইল হোসেন স্কুল অ্যান্ড কলেজের উপাধ্যক্ষ কমলেশ চক্রবর্তী ঢাকা পোস্টকে বলেন, হাবিবা ও তার মায়ের জীবনসংগ্রামের বিস্তারিত জানতে পেরে কলেজ প্রশাসনের পক্ষ থেকে হাবিবার ভর্তি ফিসহ কলেজের সকল ফি মওকুফ করা হয়েছে। হাবিবা কোনোপ্রকার ফি প্রদান ব্যতীত কলেজে নিশ্চিন্তে পড়াশোনা করতে পারবে।
আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী শরীয়তপুরের কমাড্যান্ট মো. মইনুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এ বছরের মে মাসের এক সন্ধ্যায় ঢাকা পোস্টের প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানতে পারি তাসলিমা ও হাবিবার পরিবারের জীবনসংগ্রামের কথা। পরবর্তীতে হাবিবার পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আনসার বাহিনীর মহাপরিচালক মহোদয় গ্রাম পর্যায়ে আনসার বাহিনীর সেবা পৌঁছে দিতে মানবিক এমন কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেন। হাবিবার পড়াশোনার সকল খরচ আনসার বাহিনীর পক্ষ থেকে বহন করতে চাইলেও বিস্তারিত জানতে পেরে কলেজ প্রশাসন তার ভর্তি ফিসহ অন্যান্য ফি মওকুফ করে দিয়েছে। এরপর তার প্রয়োজনীয় বইপত্রসহ অন্যান্য উপকরণ তাকে উপহার দিয়েছি। সমাজে এমন অনেক হাবিবা রয়েছে, যারা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিভিন্ন কারণে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে বাধ্য হয়। সচেতনরা একটু উদ্যোগ নিলেই এরা সমাজ ও দেশের কল্যাণে কাজ করার জন্য নিজেকে তৈরি করতে পারে। হাবিবার পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার পাশে থাকব।
সাইফ রুদাদ/এমজেইউ