অব্যবস্থাপনা আর সংস্কারের অভাবে বেহাল দশায় রাজবাড়ীর একমাত্র সরকারি হাঁস-মুরগি খামারটি। দুই যুগ ধরে এ খামারে বন্ধ রয়েছে হাঁস ও মুরগির বাচ্চা উৎপাদন। ফলে বাচ্চা উৎপাদনের শেডসহ অন্যান্য স্থাপনা ভেঙে নষ্ট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার সরকারি সম্পদ। এছাড়া খামারে ১৪টি পদের বিপরীতে লোকবল রয়েছে মাত্র ৬ জন।

কর্তৃপক্ষ বলছে, জনবল সংকটের কারণে খামারের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। তবে খামারটি সংস্কার করে পুনরায় চালু করতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানান খামার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। 

জানা গেছে, রাজবাড়ী শহরের নতুন বাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকার ভবানিপুর গ্রামে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়ক ঘেঁষে প্রায় ২ দশমিক ৮৮ একর জমির ওপর ১৯৮১-১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাজবাড়ী সরকারি হাঁস-মুরগির খামার। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর’ কর্তৃক খামারটি পরিচালিত হয়। সাধারণ মানুষের মাংস ও ডিমের চাহিদা পূরণ এবং বেকারত্ব ঘুচিয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকার প্রতিষ্ঠা করে এ খামার। এখানে মুরগির বাচ্চা পালনের জন্য রয়েছে চারটি শেড। এছাড়া প্রশাসনিক ভবন, ব্যবস্থাপকের বাসভবন, অতিথিকক্ষ, বিক্রয়কেন্দ্র, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক ভবন আছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, চারপাশে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা খামারের মূল ফটক দিয়ে ঢুকলেই বাঁ দিকে প্রশাসনিক ভবন ও ডান দিকে বিক্রয়কেন্দ্র। ভেতরে এক তলা ও টিনশেডের মোট ১৩টি স্থাপনা রয়েছে। খামারের প্রশাসনিক ভবনের বিভিন্ন স্থানের পলেস্তারা খসে পড়েছে। পানির ট্যাংকের খুঁটিগুলোর বিভিন্ন স্থানে ফাটল ধরায় সেটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবস্থাপকের বাসভবন, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আবাসিক ভবন এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। বাচ্চা পালনের চারটি শেডের মধ্যে দুটি পরিত্যক্ত। দুটি শেড, প্রশাসনিক ভবন ও বিক্রয়কেন্দ্র বাদে সব কটি ভবনই এমন জীর্ণশীর্ণ। দুই যুগ ধরে এসব ভবন সংস্কারের মুখ দেখেনি।

অব্যবস্থাপনা আর সংস্কারের অভাবে ৩টি সেডের মধ্যে ২টি শেড বন্ধ ১৫ বছর। এই দীর্ঘ সময় ডিম থেকে বাচ্চা উৎপাদন বন্ধ রাখা রয়েছে। বছরে ২০ হাজার বাচ্চা উৎপাদনের কথা থাকলেও বর্তমানে ১২ হাজার ৪০৫টি পালন করা হচ্ছে। বাইরের জেলা থেকে এসব বাচ্চা সরবরাহ করে একটি মাত্র শেডে রাখছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় নষ্ট হয়ে গেছে পানির পাম্প, জেনারেটর, গাড়িসহ বেশি কিছু মালামাল।

খামারের ব্যবস্থাপকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, খামারের জন্য বরাদ্দ করা জনবলের সংখ্যা মোট ১৪ জন। এরমধ্যে ইলেকট্রিশিয়ান, পোল্ট্রি টেকনিশিয়ানে দুইটি পদের বিপরীতে ১ জন, পোল্ট্রি ডেভেলপমেন্ট অফিসার ও হ্যাচারি এটেন্ডেন্ট পদে জনবল আছে। এছাড়া ব্যবস্থাপক, পোল্ট্রি টেকনিশিয়ান (২), অফিস সহকারী, ড্রাইভার, পোল্ট্রি এটেন্ডেন্ট, নৈশ প্রহরী, এলএমএসএস ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদগুলো শূন্য রয়েছে।

জেলা ভেটেরিনারি হাসপাতালের ভেটেরিনারি অফিসার ডা. মো. কামাল বাশার খামারের ব্যবস্থাপকের অতিরিক্ত দায়িত্বে আছেন। আর হ্যাচারি এটেন্ডেন্ট আলমগীর আকন প্রেষণে নিজের সুবিধামতো স্থানে কর্মরত আছেন। প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে খামারের কার্যক্রমে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এমনকি নামে হাঁস-মুরগির খামার হলেও আজ পর্যন্ত এখানে হাঁস পালনের কোনো কার্যক্রম শুরুই করা হয়নি।

স্থানীয় সুজন বিষ্ণু বলেন, ঠিকমতো খামারটি চালু থাকলে এলাকার লোকজন কম দামে মুরগি ও ডিম পেত। পাশাপাশি বেকার যুবকেরা এখান থেকে মুরগির বাচ্চা নিয়ে পালন করে নিজেদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারত। কিন্তু খামারটি এখন তাদের তেমন কোনো কাজেই আসছে না।

স্থানীয় ৮-১০ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ খামারে বাজারের তুলনায় অনেক কম দামে মুরগির বাচ্চা পাওয়া যায়। ফলে সাধারণ মানুষ তা কিনতে খুব আগ্রহী। কিন্তু মুরগির বাচ্চা কিনতে এসে বেশিরভাগ মানুষকেই খালি হাতে ফিরে যেতে হয়। কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের সখ্যতা আছে, তাদের কাছেই অধিকাংশ বাচ্চা বিক্রি করা হয়।

খামারের কারিগরি বিষয় দেখভালের দায়িত্বে থাকা পোল্ট্রি টেকনিশিয়ান রবিউল ইসলাম বলেন, খামার প্রতিষ্ঠার সময় চারটি শেড নির্মিত হয়। মুরগির বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল বছরে ২০ হাজার। কিন্তু দুটি শেড দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় এখন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে মুরগির বাচ্চা পালন করা হয়েছে ১২ হাজার ৪০৫ টি।জেলার চাহিদা মেটাতে এখন পার্শ্ববর্তী জেলা থেকে বাচ্চা আনতে হচ্ছে।

খামারের ব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. কামাল বাশার বলেন, জনবল সংকটের কারণে খামারের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই খামারের কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য সরকারের অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা আমরা পাইনি। তবে খামারটি সংস্কার করে পুনরায় চালু করতে সরকারের পরিকল্পনা রয়েছে।

মীর সামসুজ্জামান সৌরভ/আরকে