লেখাপড়া করলেও চাকরি নিয়ে জীবনধারণের অভীপ্সা কখনোই ছিল না এম এ রশিদ আরিফের। কিন্তু ঠিক কী কাজ আয়ের উৎস হতে পারে তা নিয়েও নিশ্চিত ছিলেন না। চিন্তা ছিল নতুন কোনো আইডিয়া নিয়ে কাজ করবেন। যে চিন্তা সেই কাজ। ২০০৪ সালে নারিকেলের মালা দিয়ে হাতেই শো-পিস বানানো শুরু করেন। নিজের বানানো শো-পিসের বাজার সৃষ্টি করতে দোকানে দোকানে ঘুরে বেড়ান। কিন্তু নিজেই সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না উৎপাদনের গতি নিয়ে।

চিন্তা করলেন বিকল্প পণ্য উৎপাদনের। ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন কাঠের কারুপণ্য তৈরি। আর তাতেই ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো এই তরুণের। ঋণ করে শুরু করা সেই ব্যবসা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় কাঠের কারুপণ্যের কারখানার মালিক এখন তিনি। দুটি কারখানায় তৈরি হয় লাখ লাখ পণ্য। বছরে দেড় কোটি টাকারও বেশি পণ্য তৈরির অর্ডার আসে দেশের নামিদামি ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠান থেকে।

রশিদ আরিফেরই এক প্রতিষ্ঠান হাসিনা কুটির শিল্প। বরিশাল বিসিক শিল্প নগরীতে প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান। প্রতিদিন ভোর হতেই সেখানে কাঠ প্রক্রিয়াজাত করে মেশিনে তুলে দেওয়ার ব্যস্ততা শুরু হয়। ৩০ জনেরও বেশি শ্রমিক সেখানে কাজ করেন।

কারখানার ব্যবস্থাপক মহিউদ্দিন মাহি বলেন, আমাদের পণ্যগুলো সাধারণত মেহগনি কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়। ভালো গাছ কিনে তা সমিল দিয়ে পাতলা কাঠ করে কারখানায় নিয়ে এসে শুকিয়ে তোলা হয় নকশার মেশিনে। নকশা হয়ে গেলে পাঠানো হয় বার্নিশে। এরপর সেগুলো আবারও পরীক্ষা করে প্যাকেট করে ক্রেতার হাতে হস্তান্তর করা হয়। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ চলে।

শুধু দেশেই নয় দেশের বাইরেও যাচ্ছে হাসিনা কুটির শিল্পের পণ্য। এ প্রসঙ্গে কারখানার আরেক কর্মী আহসান হাবিব বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের পণ্য নিয়ে বিক্রি করেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া দেশের নামিদামি ব্র্যান্ড যেমন আড়ং চুক্তিবদ্ধভাবে পণ্য নিচ্ছে। বাৎসরিক হিসেবে পণ্যের অর্ডারের তারতম্য হলেও এভারেজে প্রতি বছর লাখের অধিক পণ্য উৎপাদন হয়। এখানে গ্লাসের ঢাকনা, দেয়ালচিত্র, টিস্যুবক্স, শিশুদের পাজেল, ফুলদানি, ভিজিটিং কার্ডদানিসহ সৌখিন মানুষের ঘর ও অফিসের সৌন্দর্যের সবকিছুই তৈরি হয়।

তিনি বলেন, ব্র্যান্ডের দোকানের পোশাকের ডিজাইন কাঠে খোদাই করে দেওয়া হয়। সেই নকশা ব্যবহার করে পোশাক কারখানাগুলো ডিজাইন করে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, বড় বড় উন্নত প্রযুক্তির লেজারের দুটি খোদাই মেশিন উচ্চ শব্দ করে কাঠে নকশা তুলছে।  মেশিন থেকে নকশা হয়ে গেলে সেগুলো পাঠানো হচ্ছে আরেক কক্ষে বার্নিশের জন্য। বার্নিশ হয়ে গেলে পণ্যগুলো কারখানার কালার সেকশনে যায়। ক্রেতার পছন্দ অনুসারে রং করে তা শুকিয়ে প্যাকেটজাত করা হয়।

এ ছাড়া, কারখানার এখানে সেখানে কাঠ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। কারখানা মালিক নিজেও শ্রমিকদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

এ প্রসঙ্গে মালিক এমএ রশিদ আরিফ বলেন, আমি কখনো ভাবিনি কারখানার মালিক হতে পারব। যদিও আমার আব্বা কুটির শিল্পের সঙ্গে বহু আগে থেকেই জড়িত। তার কাজ দেখে আমি নিজেও অনুপ্রেরণা পাই। এরপর যখন নারিকেলের কারুপণ্য তৈরি শুরু করি তখন হাত শূন্য ছিল। সেটি জনপ্রিয় হওয়ার পরে ব্যবসার ধরণ বদলে একজন শ্রমিক নিয়ে কাঠের কাজ শুরু করি।

তিনি বলেন, প্রথমে আমার বাসায় এবং পরবর্তীতে চাঁনমারি এলাকায় একটি কক্ষে কাজ করতাম। পর্যায়ক্রমে মানুষের মধ্যে কাঠের পণ্যের চাহিদা বাড়ায় বিসিকে কারখানা শুরু করি। এখন চানমারি ও বিসিকে দুটি কারখানা চালু আছে। প্রতিমাসে প্রায় ১২ লাখ টাকার পণ্য ডেলিভারি দিচ্ছি।

নতুনদের উদ্দেশ্যে সফল এ ব্যবসায়ী বলেন, ব্যবসায় অনেক সুযোগ রয়েছে। তবে উদ্যোক্তাকে অবশ্যই নতুন নতুন আইডিয়া জেনারেট করে ব্যবসায় নামতে হবে। আমাদের দেশে একটি খারাপ প্রচলন হচ্ছে কারো ব্যবসার ধরণ জনপ্রিয় হলে সেটি অনেকেই নকল করা শুরু করেন। এতে করে বাজার নষ্ট হয়ে যায়। এখান থেকে না ফিরতে পারলে ব্যবসার সুষম অবস্থান তৈরি হবে না।

বিদেশি মানহীন পণ্য কারুপণ্যের সবচেয়ে বড় বাধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে আমাদের দেশের ৮টি পণ্য থাকলে বিদেশি পণ্য থাকতো দুটি। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বিপরীত। বিদেশি মানহীন পণ্য বাজার দখলে নিয়ে নিয়েছে। এখন সেইসব মানহীন পণ্য ৮টি আর দেশীয় দুটি পণ্য আছে বলেও মনে হয় না। তারপরও আমরা ভালোমানের পণ্য দিয়ে ব্যবসায় টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। সরকার যদি বাজার ব্যবস্থার প্রতি নজর দিতো তাহলে দেশীয় উদ্যোক্তা-প্রতিষ্ঠানগুলো আরো প্রসারিত হতো।

হাসিনা কুটির শিল্প মানসম্মত কাজ দিয়ে বেশ কয়েকটি পদকও জিতেছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিসিক বরিশাল জেলা কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক নজরুল ইসলাম বলেন, কুটির শিল্প নিয়ে বেশ ভালো কাজ করছে হাসিনা কুটির শিল্প। প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন করে ইতোমধ্যে নিজের পণ্যের বাজার সৃষ্টি করেছে। আমরাও চাই এভাবে সবগুলো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে যাক।

সৈয়দ মেহেদী হাসান/এমজে