জনপ্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কবিরাজি করেন যশোরের এক ইউপি সদস্য। তিনি নিজ মুখে কবিরাজি করা ও সাপে কাটা রোগীকে জরিবুটি চিকিৎসা দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এ ধরনের চিকিৎসার বৈধতা নেই।

অভিযুক্ত আব্দুল মজিদ মন্ডল যশোরের চৌগাছা উপজেলার পাশাপোল ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার।

গত সোমবার (৮ জুলাই) চৌগাছার উপজেলার রানিয়ালি গ্রামে কথিত জিন সাপের কামড়ের আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে ১২ জন নারী-পুরুষ যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। এসব রোগী জানান, প্রথমে সাপের কামড়ের আতঙ্কে তারা স্থানীয় ওই ইউপি সদস্য ও কবিরাজ আব্দুল মজিদ মন্ডলের কাছে যান। এসময় আব্দুল মজিদ মন্ডল তাদের কথিত জিন সাপে দংশন করেছে বলে কবিরাজি জরিবুটি দেন। পরে ওই সব রোগী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের স্বজনরা দুপুর ১২টার যশোর জেনারেল হাসপাতালে দিকে ভর্তি করেন।

এদিকে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা জানান, অদৃশ্য বিষধর সাপের কামড়ে ১ জুলাই গ্রামের আব্দুল হকের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (৪০) মারা গেছেন। তখন ইউপি সদস্য কথিত কবিরাজ গ্রামবাসীকে জানান, রাবেয়াকে জিন সাপে দংশন করেছে। যে কারণে চিকিৎসা দেওয়ার পরও তাকে বাঁচানো যায়নি। এরপর গ্রামে কথিত অদৃশ্য জিন সাপের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সোমবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গৌরচন্দ্র মন্ডল নামের রানিয়ালি গ্রামের এক বাসিন্দা সাংবাদিকদের জানান, তিনি মাঠ থেকে বাড়িতে ফিরছিলেন। হঠাৎ মনে হলো পায়ে কোনো কিছু কামড় দিয়েছে। এরপর শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। পরে তিনি কালিয়াকুন্ডি গ্রামের কবিরাজ ও স্থানীয় ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদের কাছে যান। কবিরাজ হাত চালান দিয়ে দেখেন তার শরীরে বিষ রয়েছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরেক রোগী বৃষ্টি বলেন, সোমবার দুপুরে রান্না করছিলাম। হঠাৎ শরীর ঝিমঝিম করে মাথাঘোরার মতো হলো। পরে শরীরে জ্বালাপোড়া শুরু হয়। স্বজনদের জানালে তারা প্রথমে গ্রামের এক মহিলা কবিরাজের কাছে নিয়ে যায়। তিনি হাত চালান দিয়ে দেখতে পান আমার শরীরে বিষ রয়েছে। পরে আমাকে যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পাশাপোল ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আব্দুল মজিদ মন্ডল ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সাপে কামড়ানোয় গাছ-গাছড়ার ওষুধ দেই ৩০-৩২ বছর ধরে। কবিরাজি করি মানে একটু গাছ-গাছড়ার ওষুধ দেই আরকি সময় পেলে।

সোমবার সাপ আতঙ্কে অসুস্থ রোগীদের অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সোমবার আমি বাড়িতেই ছিলাম না, যশোরে বিএডিসি অফিস ও পঙ্গু হাসপাতালে কাজ সেরে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরেছি।’

একজন ইউপি সদস্য ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে কবিরাজি করতে পারেন কি না– এমন প্রশ্নের জবাবে আব্দুল মজিদ বলেন, ‘না না ওরকম কোনো কবিরাজি করি না, টাকা-পয়সা নিই না, কবিরাজি নিষেধ সরকারি হিসাবে। সুবিধা-অসুবিধায় কেউ এলে গাছগাছড়ার ওষুধ দিয়ে বলি হাসপাতালে চলে যাও। সাপে কাটা রোগীদের ট্রিটমেন্ট দিয়েছি, সারা বছর যা দিয়ে থাকি, (রোগীদের) রাস্তার পাশে হওয়া কালকিসিন্দে গাছগাছড়া দিয়ে বলেছি হাসপাতালে চলে যাও।’

এ বিষয়ে পাশাপোল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অবাইদুল ইসলাম সবুজ বলেন, ‘আব্দুল মজিদ মেম্বার গুজব ছড়ায়নি। মূলত গ্রামের মধ্যে মুখে মুখে সাপে কাটার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একশর বেশি মানুষ অসুস্থ হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘আব্দুল মজিদ মেম্বার সাপে কাটার কিছু গাছগাছড়ার ওষুধ সম্পর্কে জানেন। কেউ এমন কিছু মনে করলে তার কাছে যায়, সে গাছ-গাছড়ার ঔষধ দেয়, বলে খেলে খান আর না হলে হাসপাতালে যান।’

জানতে চাইলে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক আবু হায়দার মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান জানান, কোনো রোগীকে সাপে কামড় দেয়নি। সবাই মানসিক আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মেডিকেলের ভাষায় এ রোগকে বলা হয় ‘ম্যাস হিস্টিরিয়া ইনসেক্ট বাইট’। এটি মূলত মানুষের নিউরো হরমোন ও মানসিক দ্বন্দ্বের কারণে হয়ে থাকে। হিস্টিরিয়া রোগের পেছনে আরও যে কারণগুলো রয়েছে– মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা, শারীরিক অলসতা, ভয়, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, মস্তিষ্কের সমন্বয়হীনতা অন্যতম। এ রোগে মানুষ অসুস্থ হলে প্রথমে শরীর ঝিমঝিম করে, শরীরে তাপমাত্রা বেড়ে যায়, স্পর্শনীয় অনুভূতি বুঝতে না পারা, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, অস্বাভাবিকভাবে হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া ও বুকের ধড়ফড়ানি হওয়ার মতো লক্ষণ দেখা দেয়।

যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. হারুন অর রশিদ জানান, সাপে কাটার নামে চৌগাছা থেকে আসা ১২ জন নারী হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মেডিসিন ওয়ার্ডে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। রোগীরা সুস্থ আছেন। তাদের শরীরে সাপে কাটার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। তারা সাপ আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

এ্যান্টনি দাস অপু/এসএসএইচ