ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামে সৈয়দ আবেদ আলীর বাড়ি / ছবি : ঢাকা পোস্ট

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগে গ্রেপ্তার সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী নিজ এলাকায় ‘দানবীর’ হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন সময় এলাকার মসজিদ-মাদরাসা ও অসহায়দের মাঝে আর্থিক সহায়তা প্রদানের কারণে জনপ্রিয়তাও রয়েছে তার। মঙ্গলবার (৯ জুলাই) মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। 

গ্রেপ্তার সৈয়দ আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামের মৃত আব্দুর রহমানের ছেলে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সৈয়দ আবেদ আলী মাঝে মাঝে নিজ গ্রাম পশ্চিম বোতলা গ্রামে এলেও  ২০২১ সালে ডাসারকে উপজেলা ঘোষণা করার পর অধিক পরিমাণে দান-খয়রাত শুরু করেন। আবেদ প্রথমে এলাকায় নিজের নামে মসজিদ ও ঈদগাহ নির্মাণ করে আলোচনায় আসেন। এরপর তিনি নিজেকে ডাসার উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানসহ গরিবদের মাঝে ব্যাপক দান-খয়রাত শুরু করেন। গরিবদের মাঝে শাড়ি, লুঙ্গিসহ নগদ টাকা বিতরণ, মাদরাসা ও এতিমখানায় দান করায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আবেদ আলী। কোটি টাকা মূল্যের গাড়ি নিয়ে এলাকায় এসে গরিবদের সঙ্গে কোলাকুলি করে দান-খয়রাত করায় তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। 

তবে অনেক টাকার মালিক হওয়ায় এলাকার কেউ তার বিরুদ্ধে মুখ খুলতে রাজি হয়নি বলে জানিয়েছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সচেতন মহল। আবেদ আলীর এমন জনপ্রিয়তার মধ্যে তার বিরুদ্ধে সরকারি জমি দখল ও এক গ্রাম পুলিশকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য গণস্বাক্ষর সংগ্রহের অভিযোগও রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবেদ আলীর এক বাল্যবন্ধু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বন্ধু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চেয়েছে বলেই বড় বড় নেতাদের চক্ষুশূল হয়েছে। আবেদ গরিব-দুঃখী মানুষকে সাহায্য করত, এটাই তার অপরাধ। তার থেকেও অনেক বড় বড় দুর্নীতিবাজ আছে ডাসার উপজেলায়, তাদেরকে কেউ কিছু বলছে না। আমার বন্ধু শুধু একটা বাড়ি করছে। এলাকায় তার একটা বাড়ি ছাড়া জায়গা জমি কিছু নেই। সে জীবনে অনেক কষ্ট করে বড় হইছে। ঢাকায় আমরা একসঙ্গে রিকশা চালিয়েছি। এভাবে কুলিগিরি, রিকশা চালিয়ে, গাড়ি চালিয়ে সে টাকা জমিয়েছে। পরে সে ব্যবসা করে আরও টাকা বৃদ্ধি করেছে। এখন সে গরিব মানুষকে দান করতেছে। মসজিদ-মাদরাসায় দিচ্ছে। সে যদি চেয়ারম্যান প্রার্থী না হতো, তাহলে এসবের কোনো ঘটনায় ঘটতো না।

আবুল কালাম সরদার নামে স্থানীয় একজন দাবি করেন, আবেদ আলীর বিয়ের ঘটক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবেদ এলাকায় অনেক দান করত। যে যা চাইত তারে সেভাবে সাহায্য করত। সে ঢাকায় ব্যবসা করত। মাদারীপুরেও তার ৩ চাকার টেম্পুর ব্যবসা ছিল। তার ২৫টি টেম্পু ছিল। টেম্পুগুলো যতক্ষণ তার গ্যারেজে না ফিরতো, ততক্ষণ রাতভর তিনি তার গ্যারেজে সময় দিতেন। শুনছি মাঝে মাঝে এলাকার ছেলেমেয়েদের চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতেন। এ সময় খুশি হয়ে কেউ ২০ হাজার কেউ ৫০ হাজার কেউবা ১ লাখ টাকা দিতেন তাকে। কখনো এমনটি শুনি নাই যে, তিনি নিজে কারও থেকে টাকা চেয়ে নিয়েছেন। উপজেলা চেয়রাম্যান প্রার্থী হওয়ার পরে তার সমাবেশে হাজার হাজার জনতা একত্রিত হয়ে যায়। তার এমন জনপ্রিয়তা দেখে তার বিরুদ্ধে লেগেছে মানুষ।

কদম আলী নামে একজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আবেদ ভাই তার বাড়ির সামনে দিয়ে কাঁচা রাস্তাটি পাকাকরণের জন্য এলাকার প্রায় দুই শতাধিক লোকের স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায়, রূপাই নামে এক গ্রাম পুলিশকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে তিনি ওই স্বাক্ষর সংগ্রহ করেছিলেন। সরকারি এক খণ্ড জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এছাড়া এলাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই।

বিষয়টি নিয়ে বালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশ রূপাই সরদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, রাস্তা করার জন্য আমার বাড়ির একাংশের জমি দখল করতে চেয়েছিলেনু আবেদ আলী। আমার স্ত্রী বাধা দেওয়ার পরও আবেদ আলী আমার একটি গাছের শিকড়ের মূল অংশ কেটে ফেলেন। বিষয়টি নিয়ে আমার স্ত্রী প্রতিবাদ করলে তিনি আমার স্ত্রীকেও লাঞ্ছিত করেন। পরবর্তীতে আবেদ আলী এলাকায় রাস্তা নির্মাণের কথা বলে দুই শতাধিক মানুষের স্বাক্ষর নেন। কিন্তু মূলত ওই স্বাক্ষর তিনি আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য এলাকার মানুষের মতামত হিসেবে নিয়েছিলেন। এরপর ওই স্বাক্ষরিত ফাইল ইউএনও স্যারের কাছে জমা দেওয়ার পরে আমি ব্যাপক ঝামেলায় পড়ি। আমি সৎ ছিলাম বলেই ডিসি স্যারের হস্তক্ষেপে আমার চাকরিটা রক্ষা পেয়েছিল।

বালিগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলাকায় গরিবদের মধ্যে দান-খয়রাত করলে তারা প্রশংসা করবে এটা স্বাভাবিক। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আবেদ আলী বালিগ্রামের অর্ধেক ভোটও পাইতেন না। রূপাই নামে এক গ্রাম পুলিশের সঙ্গে জমি নিয়ে দ্বন্দ্বের জের ধরে আবেদ তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য বিভিন্ন পাঁয়তারা করেছিল। ইউএনও স্যারের কাছে আবেদ আলী অভিযোগ করার পর বিষয়টি গ্রাম আদালতে পাঠিয়েছিলেন ইউএনও। পরবর্তীতে আমি ঘটনা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে বলে ইউএনওকে জানিয়েছিলাম।

প্রসঙ্গত, সরকারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে গতকাল সোমবার (৮ জুলাই) পিএসসির দুজন উপপরিচালক, একজন সহকারী পরিচালকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে পিএসসির সাবেক গাড়িচালক সৈয়দ আবেদ আলী এবং তার ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়ামও রয়েছেন। তাদের বাড়ি মাদারীপুরের ডাসার উপজেলায়।

আরএআর