দীর্ঘদিন ধরে ভারত ও চীনের টানাটানিতেই যেন ঝুলে আছে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর আবারও আলোচনায় তিস্তা মহাপরিকল্পনা। ভূরাজনীতির নানা সমীকরণ ভেদ করে একই প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে আগ্রহী হয়েছে চীনও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের মধ্য দিয়ে সমাধান চান আন্দোলনকারীরা। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন তারা।

রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, যথাযথ পদক্ষেপের অভাবে গত ৪০ বছরে মূল প্রবাহের তিন থেকে চার কিলোমিটার দূরে সরে গেছে তিস্তা। ক্রমান্বয়ে বড় হয়েছে বন্যা, ভাঙনের ক্ষয়ক্ষতি ও ঘর হারানো মানুষের সংখ্যা।
 
নদী ও পরিবেশ বিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক ড. তুহিন ওয়াদুদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরেই ঝুলে থাকা প্রকল্পটির ইতি টানা জরুরি। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, চীন কিংবা ভারত, অথবা দুই দেশ একসঙ্গে মহাপরিকল্পনা করুক। কিন্তু এই জুলাইয়ে পরিকল্পনা বিষয়ক সব ধোঁয়াশা দূর হওয়াটা জরুরি।

অধিকার কর্মীদের মতে, চীন ও ভারত তিস্তা মহাপরিকল্পনায় কীভাবে সমন্বয় করবে সেটি দ্রুত পরিষ্কার করার সময় এসেছে। না হলে এই প্রকল্প ঘিরে যে আশার আলো দেখা যাচ্ছে সেটিতে আবার ভাটা পড়বে।

তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম হক্কানী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভারত কোন অংশে কাজ করবে এবং পুরো কাজ কীভাবে হবে তা কিন্তু এখনো আমাদের কাছে পরিষ্কার না। এই ধোঁয়াশা দূর হলে উত্তরের মানুষ নতুন করে স্বপ্ন দেখতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, অসময়ের বন্যা ও ভাঙনে প্রতি বছর এক লাখ কোটি টাকার সম্পদ তিস্তার গর্ভে চলে যায়। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য নদী খনন, সংরক্ষণ ও তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই।

এদিকে তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নসহ ৬ দফা দাবিতে তিস্তা সমাবেশের ডাক দিয়েছে তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ।

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন নিয়ে আগ্রহ আছে চীনের। ২০২১ সালে তিস্তা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই শুরু করে ২০২৩ সালের মার্চে বাংলাদেশকে চীনের একটি প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন জমা দেয়। দ্রুতই তিস্তা প্রকল্প শুরু করতে আগ্রহ দেখায় তারা। বিনিয়োগেরও আগ্রহ দেখিয়েছে দেশটি।

সর্বশেষ গত ৪ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পে ভারতের সঙ্গে একযোগে কাজ করতে রাজি আছে চীন। যে কোনো সিদ্ধান্ত আমরা সম্মান করব। এ প্রকল্প নিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলাম আমরা। এখনো আমরা বাংলাদেশের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়।
 
অভিন্ন এই নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করায় পানির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে ভারতের হাতে। গ্রীষ্ম ও শীতে বাঁধ বন্ধ থাকায় পানিশূন্যতা আর বর্ষায় বাঁধ উন্মুক্ত করে দিলে বন্যায় ভাসে উত্তরাঞ্চলের মানুষ।
 
তিস্তা বাংলাদেশ ও ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। এটি ভারতের সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ও বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হয়। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, তিস্তা নদীর পানির শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকি ২৫ শতাংশ পানি নদীতে সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কীভাবে এই পানি ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোনো দিকনির্দেশনা ছিল না।
 
বহুকাল পর ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথ বৈঠকে তিস্তার পানির ৮০ শতাংশ দুই দেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। তবে ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি জানায়। নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশের স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে ভারত।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সফরসঙ্গী হিসেবে নাম ঘোষণার পর বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সফর বাতিলের কারণ তিস্তা চুক্তিতে তার সায় না থাকা।

সেই ২০১১ থেকে ২০২৪। গেল প্রায় ১৩ বছর ধরে তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি। বাংলাদেশের অধিকার থাকলেও সেই পানির ন্যায্য ভাগও পায়নি ভাটির দেশের লাখ লাখ মানুষ। ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল জলপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেওয়া হলেও ২০১৪ সালের শুষ্ক মৌসুমে তিস্তার জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেয় ভারত।

তবে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানান, তিস্তার পানি ব্যবস্থাপনা নিয়ে দ্রুতই একটি কারিগরি দল বাংলাদেশে যাবে। ভারতের এমন সিদ্ধান্তে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। চীন-ভারতের ভূরাজনৈতিক খেলায় হয়তো ঝুলেই থাকবে তিস্তা মহাপরিকল্পনা।

শরিফুল ইসলাম/আরএআর