বরগুনার বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণের বেশ কয়েক বছর পার হয়ে যাওয়ায় সংস্কারের অভাবে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে প্রায় ২৪৫টি লোহার সেতু। বিকল্প পথ না থাকায় প্রতিদিন ঝুঁকি নিয়েই এসব সেতু পার হচ্ছেন বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা। এছাড়া এমন অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ সেতু দিয়ে হরহামেশাই পার হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ছোট-বড় যানবাহন। 

সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু পার হতে গিয়ে বরগুনার আমতলীতে সেতু ভেঙে ৯ জন নিহতের পর টনক নড়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। শনাক্ত করা হয়েছে জেলার বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ সেতু।  

বরগুনা এলজিইডি কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী বরগুনার ৬টি উপজেলায় প্রাথমিকভাবে মোট ২৪৫টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি ৯৯টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে আমতলী উপজেলায়। এছাড়া সদর উপজেলায় ৬১টি, তালতলীতে ২৮টি, বামনায় ২৫টি, বেতাগী ও পাথরঘাটায় রয়েছে ১৬টি করে মোট ৩২টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব ঝুঁকিপূর্ণ সেতু শনাক্ত করা হলেও পরে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। তবে সব সেতুরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি শেষে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বরগুনায় ঝুঁকিপূর্ণ এসব সেতুর অধিকাংশতেই ছিল না সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ঝুঁকিপূর্ণ লেখা কোনো সাইনবোর্ড। সবশেষ ৯ জন নিহতের ঘটনা ঘটলে বিভিন্ন সেতুতে ঝুঁকিপূর্ণ সাইনবোর্ড সাঁটানোর কাজ শুরু হয়। বরগুনায় গত দুই বছরে বিভিন্ন এলাকার ৭টি সেতু ভেঙে পড়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে সাধারণ মানুষের তেমন বড় ধরনের  ক্ষয়ক্ষতি না হলেও সবশেষ ২২ জুন আমতলীর হলদীয়া সেতুটি ভেঙে নিহত হন শিশুসহ ৯ জন মাইক্রোবাস যাত্রী। 

সরেজমিনে বরগুনার বিভিন্ন এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি সেতু ঘুরে দেখা যায়, প্রত্যেকটি সেতুই যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুকূপে। প্রায় সেতুরই বিভিন্ন জায়গা থেকে দেবে যাওয়ার পাশাপাশি মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে গেছে লোহার অ্যাঙ্গেল। এছাড়া অনেক সেতুর বিভিন্ন স্থানের লোহার খুঁটি ভেঙে বিলীন হয়ে যাওয়ায় যানবাহন তো দূরের কথা, সাধারণ মানুষ চলাচলেই রয়েছে বড় ধরনের ঝুঁকি। এরপরও বিকল্প পথ না থাকায় ঝুঁকি নিয়েই এসব সেতু দিয়েই পার হচ্ছে বিভিন্ন যানবাহন ও সাধারণ মানুষ। 

বরগুনা সদর উপজেলার ৭নং ঢলুয়া ইউনিয়নের পোটকাখালী এলাকার নায়েব বাড়ি নামক সেতুটি প্রায় দুই বছর ধরে ভেঙে পড়ে আছে। ওই ইউনিয়নের ৭ ও ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের এটিই একমাত্র সংযোগ সেতু। ২০০২ সালে ফুটওভার ব্রিজ প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর-এলজিইডির অধীনে নির্মিত হওয়া এ সেতুটি পারাপার হতে এখন সুপারি গাছের গুড়ি দিয়ে সাঁকো বানিয়েছেন স্থানীয়রা। প্রতিদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ নানা বয়সী হাজারো মনুষ পার হয় এ সেতুটি দিয়ে। 

ঠিক একই অবস্থা বরগুনার সোনাখালী নামক এলাকার আরও একটি সেতুর। স্থানীয়দের তৈরি কাঠের পাটাতন দিয়েই সেতু পারাপার হতে হয় ওই এলাকার বাসিন্দাদের। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে সেতুটি পার হতে গিয়ে ভেঙে পড়ে পথচারীদের আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির ঘটনাও ঘটেছে কয়েকবার। নির্মাণের পর আর কোনো ধরনের সংস্কার বা বিকল্প পথের ব্যবস্থা না করায় বারবারই ঘটছে এমন দুর্ঘটনা।  

সদর উপজেলার পোটকাখালী নামক এলাকার ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি পার হয়ে প্রতিদিন কালেজে যাতায়াত করেন মরিয়ম নামের এক শিক্ষার্থী। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, এই সেতুটি প্রায় দুই বছর ধরেই ভাঙা অবস্থায় আছে। আমাদের গ্রামের ছোট, বড় সবাই এই সেতু পার হয়েই স্কুল, কলেজসহ প্রয়োজনীয় কাজে যাতায়াত করেন। দিন-রাত সবসময়ই আমাদের এই সেতু পার হতে হয়। এছাড়া সেতুটি ভাঙা থাকায় পার হতে গিয়ে তিন চারজন পড়ে আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাও নিয়েছেন। এখন সেতুটি যদি সংস্কার অথবা নতুন করে নির্মাণ করা হয় তাহলে আমাদের উপকার হয়।

সোনাখালী এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি পার হতে গিয়ে ভেঙে পড়ে আহত হন ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম। প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে এখন কিছুটা সুস্থ হয়েছেন তিনি। ঝুঁকিপূর্ণ ওই সেতুটির বিষয়ে ভুক্তভোগী সাইফুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পার হতে গিয়ে সেতুর উপরে উঠলে সিমেন্টের তৈরি একটি পাটাতন ভেঙে পড়ে যাই। এতে আমার পায়ের বিভিন্ন অংশ কেটে যায়। পরে চিকিৎসা নিতে বরগুনা হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে আমাকে বরিশালে প্রেরণ করেন। পরে দীর্ঘ প্রায় দেড় মাস হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরেছি। এ সেতুটি দিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ যাতায়াত করলেও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের কেউই সেতু সংস্কারে নজর দিচ্ছে না। সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি সেতুটি ভেঙে ফেলুক না হয় ভালোভাবে নির্মাণ করুক।

একই এলাকার বাসিন্দা শানু খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোগী পার করতে আমাদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, হয় সেতুটি সরিয়ে ফেলুক আর না হয় দ্রুত সংস্কার করুক।

বরগুনা স্টাফ কোয়ার্টার জামে মসজিদের ইমাম মোহাম্মাদ উল্লাহ প্রতিদিন প্রায় চার থেকে পাঁচবার সোনাখালীর ওই ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি দিয়ে যাতায়াত করেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ একটি ব্রিজ দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াত করি। সোনাখালী একটি বালিকা বিদ্যালয়, দুটি মাদরাসা থাকায় প্রতিদিন এ ব্রিজটি পার হতে হয় ছোট ছোট শিশু ও স্কুলপড়ুয়া অনেক ছাত্রীদের। এতে যেকোনো সময় ব্রিজ ভেঙে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বরগুনার এসব ঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলো নির্মাণের সময়েই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অনিয়ম ও গাফিলতি করেছেন, এমন অভিযোগও রয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। আর এ কারণে নির্মাণের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে সেতুগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে বলেও জানান তারা।

ঝুঁকিপূর্ণ সেতুর বিষয়ে বরগুনা এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমতলীতে একটি দুর্ঘটনা ঘটার পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে সমস্ত উপজেলায় চিঠি দিয়েছি। জেলায় কতগুলো আয়রন ব্রিজ আছে এর মধ্যে কতগুলো মেরামতযোগ্য এবং কতগুলো অমেরামতযোগ্য তার তালিকা তৈরি করে মেরামতে এবং পুননির্মাণে কত টাকা লাগবে তা নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া যে ব্রিজগুলো ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো কোনো চলমান প্রকল্পের আওতায় আছে কিনা এসব রিপোর্ট বিস্তারিত পেলে তা সমন্বয়ের পর ফাইনাল তালিকা করে ঢাকায় পাঠানো হবে। আশা করি ঝুঁকিপূর্ণ ব্রিজগুলোর বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসবে, হয়তো নতুন করে বাজেট অথবা চলমান কোনো প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

আরকে